দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন রেলওয়ে বিকাশ নিগমের এক ইঞ্জিনিয়ার, ‘‘এ ভাবে কেউ বালির বস্তা চাপায়? আপনারা দেখছি আর একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়বেন?’’
ভেঙে যাওয়া বিবেকানন্দ উড়ালপুলের থাম সরানোর কাজ শুরু হবে বলে শ্রমিকেরা দ্রুত বালি ভরছিলেন বস্তায়। বালি ভরা বস্তাগুলি সাজিয়ে রাখছিলেন ভেঙে পড়া উড়ালপুলের নীচে। মঙ্গলবার দুপুরে ঠিক সেই সময়েই ভেঙে পড়া কাঠামো সরানোর জন্য ঘটনাস্থলে হাজির হন রেল বিকাশ নিগমের ইঞ্জিনিয়াররা। সঙ্গে সহযোগী সংস্থার কর্মীরা।
কিন্তু এসেই কেন আঁতকে উঠলেন ওই ইঞ্জিনিয়ার?
রবিবার তাঁরা বলে গিয়েছিলেন, ৪০ নম্বর স্তম্ভ (যে থামটি থেকে উড়ালপুলটি ভেঙেছিল)-এর চারিদিকে শক্ত করে ঠেকনা দিয়ে রাখতে। মঙ্গলবার এসে দেখলেন ঠেকনা দেওয়া চলছে বটে, তবে বালির বস্তা দিয়ে।
আর তাতেই ঘোর আপত্তি রেলের ইঞ্জিনিয়ারের, ‘‘আমরা বলেছিলাম কংক্রিটের স্ল্যাব একটার ওপর একটা বসিয়ে স্তম্ভে ঠেকনা দিতে। সেটা আর একটা স্তম্ভের কাজ করবে। কিন্তু বালির বস্তা দিলে তো থামটি নড়বড়ে হয়েই থাকবে। হয় সেটা শ্রমিকদের ঘাড়ে ভেঙে পড়বে, কিংবা পাশের বাড়ির ওপরে।’’ রেল বিকাশ নিগমের এক ইঞ্জিনিয়ার কেএমডিএ নিযুক্ত শ্রমিকদের ঠিকাদারকে বললেন, ‘‘ইয়ে সব বালি কা বস্তা বকওয়াস হ্যায়। ইসসে কুছ নেহি হোগা। কংক্রিট কা ব্লক চাহিয়ে। কংক্রিট কা ব্লক!’’ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ২১ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। জানি না কবে কাজ শুরু করতে পারব।’’
ওই উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে কেএমডিএ-র বিরুদ্ধে। ২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনার যে তদন্ত কলকাতা পুলিশ করছে, তাতে কেএমডিএ-র বেশ কিছু অফিসারকে এ দিন তলব করেছে লালবাজার। ঘটনার
দিন কেএমডিএ-র যে অফিসারের দায়িত্ব ছিল তাঁকেও জেরার কথা ভাবছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে বলা হয়, গণেশ টকিজের কাছে বিবেকানন্দ উড়ালপুলের বিমের উপর কংক্রিটের স্ল্যাব ঢালাই করার সময় নাটবল্টু ভেঙে খুলে বেরিয়ে আসার পরেও শ্রমিকরা যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তা জানতেন তদারকির সঙ্গে যুক্ত কেএমডিএ-র একাধিক ইঞ্জিনিয়ার।
উড়ালপুলের নির্মাণকারী সংস্থা ‘আইভিআরসিএল’-এর ধৃত কর্তারা জেরায় এমনটাই জানিয়েছেন বলে পুলিশের দাবি। ধৃত কর্তারা ওই ইঞ্জিনিয়ারদের নামও জানিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও তদন্তকারীরা এখনও রাজ্য সরকারের সংস্থা কেএমডিএ-র কোন কর্তাকে গ্রেফতার করেনি।
লালবাজারের দাবি, ওই উড়ালপুল নির্মাণে যুক্ত কেএমডিএ-র বেশ কয়েক জনকে লালবাজারে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তদন্তকারীদের একাংশ জানিয়েছেন, নাটবল্টু খুলে যাওয়ার কথা ঠিকাদার সংস্থার পক্ষ থেকে কেএমডিএ-র যে ইঞ্জিনিয়ারকে জানানো হয়েছিল, দমদমের বাসিন্দা সেই কর্তা ঘটনার পর থেকেই বেপাত্তা। গোয়েন্দাদের অনুমান, বিবেকানন্দ উড়ালপুলের গণেশ টকিজের কাছে ৪০ নম্বর পিলারের একাংশ আগেই বসে গিয়েছিল, আর তার ফলে বিমের উপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর সময়ে সেখানকার নাটবল্টু ভেঙে, খুলে বেরিয়ে যায়।
ওই সময় ঢালাইয়ের কাজের জন্য উড়ালপুলের ওপর ছিলেন বেশ কয়েক জন শ্রমিক। নীচে শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলেন ঠিকাদার সংস্থার দুই সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল মান্না ও বিদ্যুৎ মান্না। যাঁদের সোমবার গ্রেফতার করেছেন তদন্তকারীরা। যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল জানিয়েছেন, আগের রাতে দায়িত্বে থাকা বিদ্যুৎবাবু সকালে শ্যামলকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যান। নাটবল্টু খুলে যাওয়ার পর শ্যামল ঘটনাস্থল থেকে ‘আইভিআরসিএল’-এর সাইট ইঞ্জিনিয়ার তথা অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার তন্ময় শীলকে ফোনে তা জানিয়েছিলেন। তন্ময় কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ধৃত শ্যামলের কাছ থেকে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এর পরেই শ্যামল দমদমের বাসিন্দা কেএমডিএ-র এক ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন করে পুরো ঘটনা বলেন। বর্তমানে শ্যামল
এবং তন্ময় পুলিশের হেফাজতে থাকলেও দমদমের বাসিন্দা ওই ইঞ্জিনিয়ারকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি।
লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘ঠিকাদার সংস্থার ধৃত অফিসাররা কেএমডিএ-র বেশ কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ারের নাম বলেছেন, যাঁরা পুরো ঘটনাটি জানতেন।’’ সোমবারই লালবাজারে ডেকে জেরার পর গ্রেফতার করা হয়েছে ‘আইভিআরসিএল’-এর হায়দরাবাদের সদর অফিসের দুই কর্তাকে। তাঁরা হলেন ডিরেক্টর (অপারেশনস) এ গোপাল কৃষ্ণমূর্তি, ডিজিএম (প্রোজেক্ট অ্যান্ড মনিটরিং) এস কে রত্নম। এ দিন আদালত তাঁদের ১১ তারিখ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
এই ঘটনায় কেন্দ্র কেন তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে না, এ বার প্রশ্ন তুলল সিপিএম। তাদের যুক্তি, ওই উড়ালপুল তৈরি হচ্ছিল জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের আওতায়। যে প্রকল্পে কেন্দ্রের
৩৫% আর্থিক সহায়তা আছে। সেই সুবাদেই কেন্দ্র এমন বিপর্যয়ের ঘটনায় তদন্ত করাতে পারে বলে দাবি সিপিএম সাংসদ
মহম্মদ সেলিমের।
এ দিনই কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে পুরো উড়ালপুল ভেঙে দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার আর্জিও রয়েছে।