বছর দুই আগে দু’লক্ষ টাকার খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য আবেদন করেও সাড়া পায়নি ঝাড়গ্রামের কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপকুমার দে’র আক্ষেপ, ‘‘আমাদের বারবার বলা হয়েছে, পেয়ে যাবেন। কিন্তু পাইনি!’’
হুগলির মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শশাঙ্কশেখর মণ্ডলের অভিজ্ঞতাও এক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, গীতা ছেড়ে ফুটবল খেল। এখানে বহু স্কুলে খেলার মাঠই নেই!’’
ঝাড়গ্রাম এবং মাহেশের স্কুল দু’টি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। কারণ খোদ রাজ্য ক্রীড়া এবং যুবকল্যাণ দফতর সূত্রেই খবর, স্কুল-কলেজগুলিকে খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য সরকারি অনুদান গত আর্থিক বছর থেকে বন্ধ। ক্লাবগুলিকে বিপুল টাকা জোগাতে গিয়ে খেলাধুলোর আঁতুড়ঘর— স্কুল-কলেজগুলিই অবহেলিত।
২০১২-র জানুয়ারিতে প্রথম বার ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সে বার ৭৮১টি ক্লাবকে অনুদান দিতে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে ক্লাব অনুদানে যুক্ত ছিল শুধু ক্রীড়া দফতর। ২০১৩ সালে এই খাতে ক্রীড়া দফতরের খরচ হয় ৪০ কোটি। সে বার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, পাঁচ বছর ধরে অনুদান পাবে ক্লাবগুলি। প্রথম বছর দু’লক্ষ, পরের চার বছর এক লক্ষ টাকা করে। ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে ফের দু’হাজার ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তাতে নতুন ও পুরনো ক্লাব মিলিয়ে খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৪ কোটির কিছু বেশি। এ বার সেই খরচ ১৫০ কোটি ছাড়িয়েছে! এর মধ্যে ১০০ কোটির মতো অর্থ দিচ্ছে ক্রীড়া দফতর। বাকিটা দিয়েছে যুবকল্যাণ দফতর। গত আর্থিক বছর থেকে এ কাজে যুক্ত হয়েছে তারা।
নবান্ন সূত্রের খবর, ক্লাব-খয়রাতি করতে গিয়ে টান পড়েছে স্কুল-কলেজে দেয় বাজেটে। রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, ক্লাব খয়রাতিতে সিংহভাগ চলে যাওয়ায় বিদ্যালয় স্তরে খেলাধুলোর উন্নয়নের জন্য আর টাকাই থাকছে না! এতে কি আখেরে রাজ্যেরই ক্ষতি হচ্ছে না? প্রাক্তন ফুটবলার ও কোচ সুব্রত ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘কোথায় কী হচ্ছে, জানি না। কিন্তু সারা বিশ্বে খেলোয়াড় বাছাইয়ের সেরা জায়গা স্কুলই। স্কুল-কলেজে খেলার উন্নয়নে সব সময়েই বেশি করে অর্থ বরাদ্দ হওয়া উচিত।’’
যুবকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর, এমনিতে স্কুল-কলেজগুলিতে খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ থাকত ১৫ কোটি টাকার মতো। স্কুল বা কলেজ সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের মাধ্যমে আবেদন করলে তা খতিয়ে দেখে মঞ্জুর করত যুবকল্যাণ দফতর। কিন্তু গত আর্থিক বছর থেকে ওই অর্থ চলে গিয়েছে ক্লাব খয়রাতির গহ্বরে! ফলে গত বছর থেকেই জেলার স্কুল-কলেজগুলিতে খেলাধুলোর সরঞ্জাম কেনার বাৎসরিক প্রক্রিয়াটি ধাক্কা খেয়েছে বলে অভিযোগ।
খেলোয়াড় তৈরির কোচিং সেন্টার বা অ্যাকাডেমিগুলোও কেউ টাকা পেয়েছে, কেউ পায়নি। যেমন এনরিকো পিপার্নো তাঁর টেনিস অ্যাকাডেমির জন্য ক্রীড়াসচিবদের দরজায় দরজায় ঘুরেও আর্থিক সাহায্য পাননি। তাঁর দাবি, সাউথ ক্লাব বা দক্ষিণ কলকাতা সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানও টাকা পায়নি। পিপার্নোর প্রশ্ন, ‘‘কারা পাচ্ছে টাকা? পাড়ার ক্লাব? ওরা খেলার কী উন্নতি করবে?’’ অ্যাথলেটিক্সের বেশ কিছু কোচিং সেন্টার অবশ্য টাকা পেয়েছে। কিন্তু একশো দশ বছরের পুরনো ফুটবল ক্লাব রহড়া সঙ্ঘ বা বারুইপুর সাগর সঙ্ঘের মতো ফুটবল কোচিং সেন্টার টাকা পায়নি! অভিযোগ, একেই ক্লাব খয়রাতির ধাক্কায় টাকায় টান। তার উপরে রাজনৈতিক ‘দাদা’দের ধরাধরির ব্যাপারও রয়েছে!
জেলার ক্রীড়া কাউন্সিলগুলিও কার্যত অকেজো এখন। রাজ্যের এক প্রাক্তন ক্রীড়া-কর্তার কথায়, ‘‘আগে ক্রীড়া কাউন্সিলগুলির মাধ্যমে স্কুল, কলেজ এবং নানা প্রতিষ্ঠানকে খেলার পরিকাঠামো উন্নয়নে অর্থসাহায্য করা হতো। এখন তা উঠে গিয়েছে।’’ নবান্নের এক কর্তার কথায়, “কবাডি, সাঁতার, টেবিল টেনিসের মতো খেলা সরকারের অনুদান ছাড়া চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু ক্লাব অনুদান চালুর পর থেকে এ সব কার্যত ব্রাত্য!”
রাজ্য সরকারের দেদার বেহিসেবি খরচ, আর তা সামাল দিতে প্রতি মাসে ধার করার সংস্কৃতি সম্পর্কে গত কয়েক বছর ধরেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি)-র দফতর। তাদের বক্তব্য, মেলা-খেলা-উত্সব-পুরস্কার, ইমাম-মোহাজ্জিনদের ভাতা, সৌন্দর্যায়ন, নীল-সাদা রং করানো, হাজার হাজার ক্লাবকে টাকা বিলিতে বিপুল খরচ হলেও তা থেকে দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভই হবে না রাজ্যের। তার পাশাপাশি সরকারের এই নয়া ক্রীড়ানীতির ফলে রাজ্যে খেলার পরিকাঠামোই ভেঙে পড়ছে বলে অভিযোগ প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, ‘‘সারা বিশ্বেই খেলোয়াড়েরা উঠে আসে স্কুল স্তর থেকে। ক্লাবগুলিকে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে গিয়ে এই সরকার খেলাধুলোর কাঠামোটাকেই অস্বীকার করছে। জেলাগুলিতে খেলার পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’’
এ ব্যাপারে ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এসএমএস করেও জবাব মেলেনি। তবে যুবকল্যাণ দফতরের এক কর্তার দাবি, ‘‘আমরা তো স্কুলগুলিতে জিমন্যাসিয়াম তৈরি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটা হয়ে গেলে আর সমস্যা হবে না।’’
(সহ-প্রতিবেদন: রতন চক্রবর্তী)