গ্রামে ঢোকা রুখতেই ১৪৪ ধারা, নালিশ বিজেপির

যে অস্ত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর-আন্দোলনকে থামাতে চেয়েছিল বাম সরকার, আজ সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করছে তৃণমূল! মাঝে আট বছরের ব্যবধান। অস্ত্রের নাম, ১৪৪ ধারা। সেটা ছিল সিঙ্গুর। এটা পাড়ুই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ সিঙ্গুরে টাটার প্রকল্প অঞ্চলে টানা ৬২ দিন ধরে ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছিল ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

পাড়ুই শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৯
Share:

চৌমণ্ডলপুরে চলছে পুলিশি টহল।

যে অস্ত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর-আন্দোলনকে থামাতে চেয়েছিল বাম সরকার, আজ সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করছে তৃণমূল!

Advertisement

মাঝে আট বছরের ব্যবধান। অস্ত্রের নাম, ১৪৪ ধারা। সেটা ছিল সিঙ্গুর। এটা পাড়ুই।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ সিঙ্গুরে টাটার প্রকল্প অঞ্চলে টানা ৬২ দিন ধরে ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছিল ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা যাতে প্রকল্প এলাকার কাছে না ঘেঁষতে পারেন। মমতা সেই সময় প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। হাইকোর্টে গিয়ে ১৪৪ ধারা তুলিয়েছিল তৃণমূল। আজ সেই মমতাই শাসক। আর তাঁর পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠল, রবিবার বিরোধী দল বিজেপির প্রতিনিধিদের পাড়ুইয়ের চৌমণ্ডলপুর গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য রাতারাতি ১৪৪ ধারা জারি করার। এ দিন ওই গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরেই ব্যারিকেড করে আটকে দেওয়া হয় বিজেপির বীরভূম জেলার নেতাদের। তা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।

Advertisement

প্রত্যাশিত ভাবেই প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিজেপি। দলের জেলা সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, “শনিবার রাতেই জেলা পুলিশ সুপারকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, রবিবার চৌমণ্ডলপুর গ্রামে আমাদের প্রতিনিধিরা যাবেন। ১৪৪ ধারা তার পরেই জারি করা হয়েছে।” বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের দাবি, “পুলিশ শাসকদলের নির্দেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে।” বিজেপি বিধায়ক তথা রাজ্য নেতা শমীক ভট্টাচার্য আবার মনে করেন, তৃণমূল নির্ভুল ভাবে সিপিএমের একটা স্বৈরতান্ত্রিক ভুলকে অনুকরণ করছে। তাঁর কটাক্ষ, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন তুলে সিঙ্গুরে ১৪৪ ধারা জারি করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। আর এখন যখন গ্রামে পুলিশ ও তৃণমূলের অত্যাচার চলছে, তখন মানুষের প্রতিবাদ ঠেকাতে তিনিই ১৪৪ ধারা জারি করছেন!”

বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের শক্ত ঘাঁটি পাড়ুইয়ে তাঁদের দল সংগঠন বাড়াচ্ছে। আর তাতেই ভয় পেয়ে পুলিশ দিয়ে তাঁদের ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য বলেন, “কেন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, সে নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। এটা পুলিশের নিজস্ব ব্যাপার।”

শুক্রবার দুপুরে চৌমণ্ডলপুর গ্রামে বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের মারে পাড়ুই থানার ওসি জখম হন। ওই দিনই সাত্তোর-কসবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয় ৫০০টি বোমা। কমব্যাট ফোর্স নিয়ে চৌমণ্ডলপুর এবং পাশের রাঘাইপুর ও গোলাপবাগ গ্রামেও তল্লাশি চালায়। গোটা এলাকা থেকেই র্যাফ ও কমব্যাট বাহিনীর তল্লাশির নামে নিরীহ লোকজনকে ধরপাকড় এবং তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠেছে।

ওই ঘটনার পর থেকেই চৌমণ্ডলপুর গ্রাম ছিল কার্যত পুরুষশূন্য। রবিবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, হাজার খানেক ভোটারের গ্রাম দৃশ্যতই খাঁখাঁ করছে। গ্রামের প্রায় বাড়ির দরজা-জানলাই বাইরে তেকে বন্ধ। লোকজন নেই। গ্রামে চরে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগল। আর রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ বাহিনী। মাইকে ঘোষণা করে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এ দিন এই জনমানবহীন গ্রামেই বেলা ১১টা নাগাদ ১৪৪ ধারা জারি কথা জানানো হয়। গ্রামে ঢোকার ২ কিমি আগে থেকেই চলছে পুলিশের কড়া পাহারা। যে সমস্ত রাস্তা অন্য গ্রামের সঙ্গে চৌমণ্ডলপুরকে যুক্ত করেছে, সেই রাস্তাগুলিতে বসেছে ব্যারিকেড। কেউ প্রবেশ করতে পুলিশের হাজারো প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। ছাড় নেই সংবাদমাধ্যমেরও।

এমনই পরিস্থিতিতে বেলা ১২টা নাগাদ সেখানে পৌঁছয় জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের নেতৃত্বে বিজেপির প্রতিনিধি দল। ছিলেন রাজ্য কমিটির সদস্য নির্মল মণ্ডল, জেলা সহ সভাপতি দিলীপবাবু। কিন্তু, গ্রামে ঢোকার এক কিলোমিটার আগে আটকে দেওয়া হয় বিজেপি নেতাদের। দুধকুমারবাবু আক্রান্ত গ্রামবাসীদের দেখতে যাওয়ার কথা বললে, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় অনুমতি দেননি। এর পর উভয়েই বচসায় জড়ান। দুধকুমারবাবু ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “পুলিশ সুপার আমাদের ওই গ্রামে যাওয়ার মৌখিক ভাবে অনুমতি দিয়েছিলেন। আর এখানে এসে দেখছি, পুলিশের পুরো উল্টো আচরণ!”

পুলিশ কোনও ভাবেই চৌমণ্ডলপুরে তাঁদের ঢুকতে দেবে না বুঝে বিজেপি নেতারা যান লাগোয়া গোলাপবাগ গ্রামে। সেখানে গিয়ে গ্রামবাসীদের মুখ থেকে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ শোনেন। স্থানীয় স্কুলপাড়ার বাসিন্দা, অসুস্থ বৃদ্ধ শেখ সালেমকেও পুলিশ মারধর করেছে বলে অভিযোগ। একই পাড়ার বাসিন্দা রহওসনা বিবি, রাজমা বিবি, সাকিলা বিবিরা পুলিশি তাণ্ডবের কথা সবিস্তার জানান বিজেপি নেতৃত্বকে। রাজমা বিবি তাঁর ডান পায়ে পুলিশের লাঠির আঘাতের চিহ্ন দেখান। তালিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া শেখ সালমার, শেখ সুজাইদেরও পুলিশ মেরেছে বলে দাবি। রহওসনা বিবি, শাহিদা বিবিরা বিজেপি নেতৃত্বকে বলেন, “পুলিশ ও তৃণমূলের গুণ্ডা বাহিনী আমাদের সারের দোকান ও বাড়িতে লুঠপাট চালিয়েছে।” স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শুধু চৌমণ্ডলপুর নয়, আশপাশের জনপদগুলিতে গত ২৪ ঘণ্টায় কম করে দশ বার তল্লাশি অভিযান চলেছে।

পুলিশের ভূমিকার নিন্দা শোনা গিয়েছে গোলাপবাগ গ্রাম থেকে নির্বাচিত তৃণমূলের সদস্য সামসুনেহা বিবির মুখেও। তৃণমূল পরিচালিত মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের ওই সদস্যা বলেন, “পুলিশের উপরে হামলার দিন গ্রামে ছিলাম না। তবে, অভিযুক্তদের ধরার নামে নিরপরাধ মহিলা ও শিশুদের উপর পুলিশি হামলা কাম্য নয়। এর তীব্র নিন্দা করছি।” দুধকুমারবাবু পরে বলেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাস এবং পুলিশের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। তাতে দলে দলে মানুষ বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে। তৃণমূলের পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও রাজ্য নেতৃত্ব জানিয়েছি এখানকার পুলিশি অত্যাচারের কথা।” আজ, সোমবার দলের রাজ্য নেতৃত্বের চার সদস্যের একটি দল এলাকায় আসবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।

অন্য দিকে, পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় দুই মহিলা সহ আরও পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার রাতে চৌমণ্ডলপুর থেকে নঈমা বিবি, নাজমুন্নিসা বিবি, বাবর আলি শেখ নাসিরুদ্দিন ও শেখ নবী নওয়াজ নামে ওই পাঁচ জনকে ধরা হয়। রবিবার ধৃতদের সিউড়ির বিশেষ আদালতে তোলা হলে বিচারক দুই মহিলা-সহ তিন জনকে ১৩ দিন জেল হাজতে থাকার নির্দেশ দেন। বাকি দু’জনের পুলিশি হেফাজত হয়। এই নিয়ে মোট ১০ জনকে ধরল পুলিশ। এ দিনই দুপুরে আহত ওসিকে দেখতে সিউড়ি হাসপাতালে যান আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত। পরে তিনি চৌমণ্ডলপুরেও যান। আইজি বলেন, “আমাদের কাছে খবর আছে, ওসি-র উপরে হামলার দিন ওই গ্রামে বেশ কিছু মাস্কেট ব্যবহার করা হয়েছিল। সেগুলি উদ্ধার করা হবে।”

(সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত)

বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি ও নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন