North Bengal Situation

ফুঁসছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা! ডুয়ার্সে জলমগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা, নিরাপদ স্থানে সরানো হল বহু মানুষকে, নদীতে ভাসল গণ্ডারও

রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা মিলে একযোগে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। জলমগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্রও খোলা হয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ২২:২২
Share:

ভারী বৃষ্টিতে জলমগ্ন ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ এলাকা। —নিজস্ব চিত্র।

নাগাড়ে বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গ। পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় ধস নেমেছে। এখনও পর্যন্ত অন্তত ২০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে পাহাড়ে। শুধু পাহাড়ই নয়, বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চলও। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে একে বারে উত্তরের পাঁচ জেলায়। ফুলেফেঁপে উঠেছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, জলঢাকা-সহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলি। সোমবারও উত্তরের জেলাগুলিতে বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে আলিপুরদুয়ারে। সে ক্ষেত্রে উত্তরের সমতল এলাকাগুলিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

Advertisement

শনিবার রাতেই মহানন্দা নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়ে শিলিগুড়ির পোড়াঝাড় এলাকায়। ধসে গিয়েছে বেশ কিছু বাড়ি। ঘরছাড়া হয়ে পড়েন বহু মানুষ। ওই এলাকায় প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিলিগুড়ি পুর এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও জলমগ্ন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন যৌথ ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

রবিবার সকালেই জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন মহানন্দা নদীর ব্যারেজের লকগেট খুলে দেয়। তার ফলে জল কিছুটা নামতে শুরু করে। তবে পরিস্থিতি এখনও জটিল হয়ে রয়েছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয়ে রয়েছে নাগরাকাটা, বানারহাট, ময়নাগুড়ি এবং ধুপগুড়ি থানা এলাকায় মূর্তি, ডায়না এবং জলঢাকা নদীর সংযোগস্থলে। চার থানা এলাকাতেই জলমগ্ন এলাকাগুলি থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা মিলে একযোগে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। জলমগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্রও খোলা হয়েছে। সেখানে তাঁদের খাবার এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত বামনডাঙা এবং নাগরাকাটা থানা এলাকা থেকে মোট পাঁচ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে।

Advertisement

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

অন্য দিকে কোচবিহারে ক্রমশ বাড়ছে তোর্সা নদীর জল। বর্তমানে তোর্সা নদী দৃশ্যত ফুঁসছে। বিপদসীমায় বইছে তোর্সা। কোচবিহার সদর এলাকায় পুরসভার ২০টি ওয়ার্ডে রবিবার সকালে হাঁটুর উপর জল ছিল। সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি ছিল কোচবিহার মিনি বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, রাজবাড়ি সংলগ্ন এলাকা কলাবাগান, কদমতলা, হাসপাতাল চৌপতি, বিশ্বসিংহ রোড, সুনীতি রোডে। সন্ধ্যায় সেই জল অনেকটাই কমেছে। তবে দু’টি ওয়ার্ডের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কোচবিহারের ১৬ এবং ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তোর্সা নদীর চর সংলগ্ন এলাকার বাড়িগুলিতে জল ঢুকতে শুরু করেছে। সেখানকার বাসিন্দারা ঘর থেকে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে বাঁধে ত্রিপল টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ফুঁসছে জলঢাকা নদীও। মাথাভাঙা ২ ব্লকে নদী তীরবর্তী কেদারহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ওই এলাকায় স্পিড বোট নিয়ে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে প্রশাসন।

কোচবিহারের পরিস্থিতি নিয়ে রবিবার দুপুরে জেলাশাসকের দফতরে ওই বৈঠক হয়। জেলাশাসক অরবিন্দ কুমার মিনার সঙ্গে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। জেলার পুলিশ সুপার এবং সেচ দফতরের আধিকারিকেরাও উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। কোচবিহারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জেলাশাসক বলেন, “গতকাল থেকে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে কোচবিহার সহ উত্তরবঙ্গে। পরিস্থিতি ঠিক রাখতে আমাদের সবরকম ব্যবস্থা এবং টিম তৈরি রয়েছে। কিছু টিম ইতিমধ্যে মাঠে নেমে কাজ করছে। তিস্তা, তোর্সা-সহ বিভিন্ন নদীর জলস্তর বাড়ছে। আমরা সেই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি।”

তোর্সায় ভেসে এল গণ্ডার

নাগাড়ে বৃষ্টির জেরে জল ঢুকছে তরাই-ডুয়ার্সের বনাঞ্চলগুলিতেও। কোচবিহার দু নাম্বর ব্লকের কাঁঠালবাড়ি নয়ারহাট এলাকায় তোর্সা নদীতে ভেসে আসে একটি পূর্ণবয়স্ক গণ্ডার। মনে করা হচ্ছে, প্রবল বৃষ্টির কারণে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য থেকে গণ্ডারটি জলের তোড়ে ভেসে কোচবিহারে চলে এসেছে। কোচবিহারের অতিরিক্ত বন আধিকারিক বিজন নাথ জানান, উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টির জেরে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য থেকে একটি গণ্ডার তোর্সার জলে ভেসে কোচবিহারে চলে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা গণ্ডারটির উপর নজর রেখে চলেছি। প্রয়োজনে সেটিকে উদ্ধার করে আবার জলদাপাড়ায় ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে গণ্ডারটি স্ত্রী না পুরুষ, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আপাতত গণ্ডারটি সুস্থ অবস্থায় নদীর চরেই রয়েছে।”

গরুমারার জঙ্গল লাগোয়া জলঢাকা নদীতেও একটি গন্ডারের দেহ ভেসে আসে। অন্য দিকে, নকশালবাড়িতে মেচি নদীর স্রোতে তলিয়ে গিয়েছে একটি হস্তিশাবক। রবিবার বেলায় ৩০টি হাতির দল মেচি নদী পেরোচ্ছিল। সেই সময় একটি হস্তিশাবক দলছুট হয়ে পড়ে। ভারী বৃষ্টিতে আচমকা নদীর জল বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে যায় ওই হস্তিশাবকটি।

জলদাপাড়ায় ফুঁসছে হলং, সীসামারা

উত্তরের ভারী বৃষ্টির জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে হলং নদীর। রবিবার সকাল থেকে নদী দৃশ্যত ফুঁসছে। তার জেরেই ভেঙে পড়ে এই নদীর উপরে থাকা একটি কাঠের সেতু। সেতু ভেঙে যাওয়ার ফলে জলদাপাড়ার কিছু এলাকা বাকি ডুয়ার্সের বাকি অংশের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জলদাপাড়া ট্যুরিস্ট লজে যাওয়ার একমাত্র পথ হল এই সেতু। এটি ভেঙে পড়ায় অতিথিবাসে আটকে পড়েছেন বেশ কয়েক জন পর্যটক। জলদাপাড়ায় সীসামারা নদীও ফুঁসছে। বিভিন্ন জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙে গিয়ে গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করেছে। সীসামারায় বিভিন্ন কটেজ এবং হোমস্টেগুলিতে বহু পর্যটক আটকে পড়েছেন।

সজাগ দুই দিনাজপুর এবং মালদহও

একেবারের উত্তরের জেলাগুলিতে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হলেও দুই দিনাজপুর এবং মালদহের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভাল। শনিবার রাতে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু জায়গায় বৃষ্টি হলেও রবিবার বৃষ্টির পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। দুই দিনাজপুরই মোটের উপর মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও খুব বেশি বৃষ্টি হয়নি। আত্রেয়ী, পুনর্ভবা এবং টাঙ্গন নদীতে জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে বৃষ্টি নামলে এই নদী সংলগ্ন এলাকাগুলিতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে মালদহেও মহানন্দা নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নতুন করে বৃষ্টি না-হলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে দার্জিলিং এবং ডুয়ার্সের দুর্যোগের পরে পরিস্থিতির দিকে সজাগ নজর রাখছে এই তিন জেলাই।

সোমবার উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী

উত্তরবঙ্গের দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে রবিবার সকাল থেকেই নজর রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তরের জেলাগুলির সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকও সেরেছেন তিনি। সোমবার মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে নিয়ে তিনি পৌঁছে যাবেন উত্তরবঙ্গে। শিলিগুড়ি থেকে গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখবেন তিনি। উত্তরবঙ্গের বিপর্যয়ে বহু পর্যটক আটকে পড়েছেন। মমতা জানিয়েছেন, তাঁদের নিরাপদে বাড়ি ফেরানোর বন্দোবস্ত করবে রাজ্য সরকার। আপাতত কেউ যেন ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো না করেন। হোটেলগুলি যেন পর্যটকদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া না-নেয়, সেই অনুরোধও করেছেন তিনি। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন জানান, সার্বিক পরিস্থিতির কথা তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement