‘বিন্দুমাত্র ছিল না বড় লেখকের অহঙ্কার’

রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় অর্ধশতাব্দীর৷ তারও আগে তাঁর অসামান্য রচনার সঙ্গে পরিচয়৷ ছাত্রজীবনে তাঁর ‘প্রথম প্রহর’ পড়ার অভিজ্ঞতা ভুলি কী করে? অনেক পরে যখন পরিচয় হল, তখন চিনলাম এক ক্ষুরধার মেধাসম্পন্ন মানুষকে৷

Advertisement

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৮ ০৫:০১
Share:

ছিয়ানব্বই বছর বয়সে তিনি স্মৃতিধার্য হয়ে গেলেন। তবু থাকা না-থাকার মধ্যে যে-দুস্তর ব্যবধান, তা আমাদের কাছে বেদনাবহ।

Advertisement

রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় অর্ধশতাব্দীর৷ তারও আগে তাঁর অসামান্য রচনার সঙ্গে পরিচয়৷ ছাত্রজীবনে তাঁর ‘প্রথম প্রহর’ পড়ার অভিজ্ঞতা ভুলি কী করে? অনেক পরে যখন পরিচয় হল, তখন চিনলাম এক ক্ষুরধার মেধাসম্পন্ন মানুষকে৷ রবিবাসরীয় পত্রিকার সম্পাদনা করতেন আশ্চর্য দক্ষতায়৷ রসবোধ ছিল প্রবল৷

মনে আছে এক বার তাঁকে কালী পুজো ‘ওপেন’ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন কয়েক জন৷ রমাপদবাবু একটু হেসে বললেন, ‘মা কালীর তো সবই ওপেন, আর ওপেন করার কী আছে!’ লেখক হিসেবে খুব অলস ছিলেন। সারা বছর লেখার নামগন্ধ নেই। পুজোর উপন্যাস লেখার সময়ে কলমে কালি ভরতেন৷ বছরে ওই এক বার৷ বিদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করতেন৷ পোশাক ছিল ধুতি, বাফতা-র পাঞ্জাবি আর কোলাপুরি চটি৷ কখনও অন্য পোশাক পরেননি৷ এক সময়ে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন তুঙ্গে উঠেছিল যে, তাঁকে গাড়ি কেনার টাকা দিয়েছিল এক প্রকাশক৷ দীর্ঘদিন তিনি তাঁর ছোট গাড়িটা নিজেই চালিয়ে অফিস বা অন্যত্র যাতায়াত করেছেন৷ বাঙালি লেখকদের মধ্যে এটি বিরল ঘটনা৷ বিরল আর একটি ব্যাপারও৷ নিজের ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন তিনি নিজেই তৈরি করতেন৷

Advertisement

টানা কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে দেখেছি, তাঁর চেহারার কোনও পরিবর্তন নেই৷ শুধু মাথার চুল হয়তো কয়েকটা বেশি পাকত, তার বেশি কিছু নয়৷ অসুখবিসুখ কদাচিত হত৷ এমন ফিটনেসও অবাক হওয়ার মতো৷ পুরী ছিল তাঁর সব চেয়ে প্রিয় বেড়ানোর জায়গা৷ বলতেন, ‘কত বার যে পুরী গিয়েছি, তার হিসেব নেই৷’ বৌদি তাঁর চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট এবং ভারী সুন্দরী। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এত ভালবাসা দেখাই যায় না৷ খুব হাতে গোনা কয়েক জন অন্তরঙ্গ ছাড়া কখনও কাউকে তুই বা তুমি করে বলতেন না৷ সবাইকেই আপনি৷ এমনকি বয়সে অনেক ছোট অফিসের সহকারীদেরও সব সময়ে আপনি করে বলতেন৷ চা আর সিগারেট ছাড়া কোনও নেশা ছিল না৷ সিগারেট তিন বার ছেড়ে তিন বার ধরেছিলেন এই বর্ণময় মানুষটি৷ অনেকটা শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে গেলেন৷

আরও পড়ুন: গল্প কী করে লিখতে হয়, শিখেছি ওঁর লেখা পড়ে

অনেক জন নবীন লেখক তাঁরই আবিষ্কার৷ তাঁর দফতরেই ফি-শনিবার নবীন লেখকেরা আসতেন৷ তুমুল আড্ডা হত, চা-মুড়ি হত, সঙ্গে তেলেভাজা৷ কাউকে কখনও উপদেশ দিতেন না৷ বড় লেখকের অহঙ্কারও বিন্দুমাত্র ছিল না তাঁর৷ মানুষ এবং লেখক, দুই হিসেবেই রমাপদ চৌধুরী বিশিষ্ট৷ বাঙালি তাঁকে মনে রাখবে৷

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন