মুকুলের ইফতার থেকে ফিরে সাসপেন্ড শিউলি-শীলভদ্র

মুকুল রায়ের আপাত-সাধারণ ইফতারই প্রবল চাঞ্চল্য তৈরি করে ফেলল তৃণমূলে! দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুলের ইফতার-আসরে রবিবার সন্ধ্যায় প্রত্যাশিত ভাবেই হাজির ছিলেন তৃণমূলের দুই বিধায়ক শিউলি সাহা ও শীলভদ্র দত্ত। ঘটনায় বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ইফতার-আসরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দুই বিধায়ককে দল থেকে সাসপেন্ড করলেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫ ০৩:৩১
Share:

মুকুলের ইফতারে শিউলি সাহা ও শীলভদ্র দত্ত। রবিবার।

মুকুল রায়ের আপাত-সাধারণ ইফতারই প্রবল চাঞ্চল্য তৈরি করে ফেলল তৃণমূলে!

Advertisement

দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুলের ইফতার-আসরে রবিবার সন্ধ্যায় প্রত্যাশিত ভাবেই হাজির ছিলেন তৃণমূলের দুই বিধায়ক শিউলি সাহা ও শীলভদ্র দত্ত। ঘটনায় বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ইফতার-আসরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দুই বিধায়ককে দল থেকে সাসপেন্ড করলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দু’জনকে শাস্তি দিয়ে আসলে মুকুল-শিবিরকেই বার্তা দেওয়া হল বলে তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা। কিন্তু শাস্তির সিদ্ধান্ত যে হেতু ইফতার-আসরের পরেপরেই, তাই সংখ্যালঘুদের প্রতি বার্তার প্রশ্ন তুলে তৃণমূলকেই আবার পাল্টা অস্বস্তিতে ফেলে দিল মুকুল-শিবির! তাদের প্রশ্ন, সংখ্যালঘুদের ইফতার-আসরে যাওয়া কি তৃণমূলে ‘অপরাধ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে এখন?

শাস্তি দেওয়ার কারণ হিসাবে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য মুকুল-স্পর্শ এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা থেকেই মুকুল-শিবিরকে বার্তা দেওয়ার কৌশল স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সোমবার বলেছেন, ‘‘ধারাবাহিক ভাবে দল-বিরোধী নানা কার্যকলাপে যুক্ত থাকার জন্য পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ার বিধায়ক শিউলি সাহা এবং উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্তকে দল থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।’’ প্রশ্ন থাকছে, ‘ধারাবাহিক ভাবে’ যাঁরা দল-বিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে এত দিন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? আরও প্রশ্ন, খাতায়-কলমে মুকুল তো এখনও তৃণমূলেরই সাংসদ। তা হলে তাঁর আসরে যাওয়ার জন্য শাস্তির মুখে পড়তে হবে কেন? মুকুল-ঘনিষ্ঠ এক নেতা যে কারণে বলছেন, ‘‘ইফতারে যাওয়ার পর দিনই দু’জনকে সাসপেন্ড করে বুঝিয়ে দেওয়া হল, দাদার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে তৃণমূল নেতৃত্ব ভয় পাচ্ছেন!’’

Advertisement

নিজাম প্যালেসে রবিবারের ওই ইফতার-আসরে ব্যবস্থাপনা ছিল আড়াই হাজার লোকের। শেষ পর্যন্ত হাজির হয়েছিলেন প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি ব্লক থেকেই মানুষ এসেছিলেন। ইফতার-আসরে ওই বিপুল সাড়া মুকুল-শিবিরের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিল। আর তার পর দিনই তৃণমূল নেতৃত্ব যে ভাবে দুই বিধায়ককে শাস্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বসেছেন, তাতে মুকুলের পরিকল্পনায় শাসক শিবিরে হৃত্কম্পের চিহ্ন স্পষ্ট বলেই মনে করছেন প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকরে ঘনিষ্ঠেরা। তৃণমূল শিবিরেও চর্চা শুরু হয়েছে, শিউলি বা শীলভদ্র রাজনৈতিক ভাবে বিশেষ ওজনদার কেউ নন। ইফতারের পরদিনই শাস্তি দিয়ে তাঁদের প্রকারান্তরে প্রচারের আলোয় এনে ফেলে নিজেদের মুকুল-আতঙ্ক প্রকট করে তোলার কি খুব দরকার ছিল?

তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বিধায়ককে দল থেকে সাসপেন্ড করার কথা শুনে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি স্বয়ং মুকুল। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের নিয়ে এ দিন সন্ধ্যায় নিজাম প্যালেসে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন তিনি। পরে তিনি বলেন, ‘‘দলের কেউ কোনও বিবৃতি দেননি। সাংবাদিক বৈঠক করেননি। যা শুনেছি সবই সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে। ফলে, মন্তব্য করতে যাব কেন!’’ তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ‘‘রমজানের সময় ইফতারের আসরে যোগ দেওয়ায় যদি কাউকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়, তা হলে সংখ্যালঘুদের প্রতি সেই দলের মনোভাব সহজেই বোঝা যায়!’’

বস্তুত, সাধারণ সাংসদ হিসাবে থেকে গেলেও মমতার দলে মুকুলের ইনিংস এখন কার্যত অতীত। তিনি নতুন দল গড়ে রাজ্য রাজনীতিতে নয়া ইনিংস শুরু করবেন কি না, তা নিয়েই জল্পনা চলছে। যা আরও গতি পেয়েছে রবিবার তাঁর ইফতার-আসরের পরে। এমতাবস্থায় মুকুলের দিকে যাতে আরও বেশি সংখ্যায় দলের নেতা-বিধায়কেরা ঝুঁকে না পড়েন, তা নিশ্চিত করতে চেয়েই এমন তড়িঘড়ি তাঁর ঘনিষ্ঠ দু’জনকে শাস্তির সিদ্ধান্ত বলে শাসক শিবিরের ব্যাখ্যা। নিজাম প্যালেসে ইফতার চলাকালীনই রবিবার তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, শিউলিদের আর রেয়াত করা চলবে না। সেইমতোই এ দিন সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত। তৃণমূলের এক সাংসদের কথায়, ‘‘ইফতার আসরটা বড় কথা নয়। দলের মঞ্চ নয়, এমন একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে দীপক ঘোষের মতো কেউ নতুন দল গড়া হবে বলে ঘোষণা করছেন। সেই মঞ্চে দলের তরফে কেউ থাকলে তাঁদের শাস্তি না দিয়ে কোনও উপায় আছে?’’ কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থাকছে, তা হলে তো মুকুলকেই সর্বাগ্রে শাস্তি দিতে হয়! দলের একাংশের আরও আশঙ্কা, এর পরে শিউলিরা আরও খোলাখুলি মুকুল-শিবিরের কাজকর্ম করবেন!

মুকুল-ঘনিষ্ঠ আর এক বিধায়ক, সিউড়ির স্বপনকান্তি ঘোষ ইতিমধ্যেই সাসপেন্ডেড। শিউলি ও শীলভদ্রের উপরে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসায় আপাতত একসঙ্গে শাসক দলের তিন বিধায়ক সাসপেনশনের আওতায় পড়লেন। হলদিয়া ও ব্যারাকপুরের বিধায়কদের সাসপেন্ড করার কথা বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে পার্থবাবু জানিয়েছেন।

অনুগামীদের শাস্তি দিয়ে তৃণমূল নেত্রী মুকুলের পথে কাঁটা বেছানোর চেষ্টা করলেও শিউলি-শীলভদ্রেরা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। এমনিতেই তৃণমূলে সাসপেনশনের চিঠি পাওয়ার নজির বিরল! তাঁরা দু’জনও সাসপেনশনের খবর জেনেছেন সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে। তবে দু’জনেই স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে যোগদান যদি অপরাধ হয়ে থাকে এবং তার জন্যে যদি আমাদের উপর শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে, তা হলে আমরা পিছিয়ে যাব না। ওই রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এক বার নয়, একশো বার, লক্ষ বার যাব!’’

সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে বিশদে কোনও মন্তব্য করা উচিত নয় বলেও জানিয়েও শীলভদ্র বলতে ছাড়েননি, ‘‘আমাদের নেতা মুকুল রায়। আমরা সংখ্যালঘুদের অনুষ্ঠানে গিয়ে অন্যায় কিছু করিনি। এই ধরনের কাজে আমাদের নেতা আগামী দিনে আমাদের পাশে থাকবেন বলেই আশা করি।’’ আর শিউলি জানিয়েছেন, তিনি তফসিলি জাতিভুক্ত বিধায়ক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা অনুন্নত শ্রেণির আমন্ত্রণে কোনও অনুষ্ঠানে তিনি যেতেই পারেন বলে তাঁর দাবি। শিউলির কথায়, ‘‘দল-বিরোধী কোনও কাজ করিনি। অন্য কোনও দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও যোগ দিইনি। একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। অন্যায় তো কিছু করিনি!’’

শিউলিকে শাস্তি দিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী শিবিরকে অবশ্য কিছুটা কাছে টানতে পেরেছেন তৃণমূল নেত্রী। হলদিয়ার বিধায়ক শিউলিকে কাজে লাগিয়ে শুভেন্দু অধিকারীদের বিব্রত করার নানা চেষ্টা যে চলত, তা এখনও ভোলেননি ওই জেলার নেতাদের বড় অংশই। তখনও অবশ্য শিউলির ‘মেন্টর’ ছিলেন মুকুল! সেই শিউলি শাস্তির মুখে পড়ার পরে শুভেন্দু এ দিন বলেছেন, ‘‘দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দলের সৈনিক হিসাবে সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।’’ তৃণমূলের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সভাপতি শিশির অধিকারীর চ়়ড়া সুরেই প্রতিক্রিয়া, ‘‘দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণেই শিউলিদেবীকে দল সাসপেন্ড করেছে। দলের হাইকম্যান্ড (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে জেলায় দলের কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ, জেলায় ওঁর কোনও রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই!’’

নন্দীগ্রামের জেলায় অধিকারী-শিবিরকে স্বস্তি দিলেও সাসপেনশনের সিদ্ধান্তে সংখ্যালঘু-অস্বস্তি আবার নিজেদের দিকে টেনে আনল মমতার দল! নেপথ্যে সেই মুকুল রায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন