রসের উৎসবে
মেলা আম
‘বেতের ডালায় রেশমি - রুমাল – টানা/ অরুণবরণ আম এনো গোটাকত৷’ দুঃসহ গরমেও এই নিমন্ত্রণ-এ রসনায় ধারাবর্ষণ হবে, সন্দেহ নেই৷
আমের যত গল্প তার প্রায় সবই মুর্শিদাবাদ আর মালদহকে ঘিরে৷ বলতে গেলে ওই দুই জেলাই এ বাংলার আম্র-রাজধানী৷ কিন্তু তারই মধ্যে গুটি-গুটি ঢুকতে শুরু করেছে বাঁকুড়া৷ বছরে একশো দিন কাজের প্রকল্পে রাজ্যের উদ্যানপালন দফতর গড়ে তুলেছে ২৫৩টি আমবাগান৷ তারই ফসল আমগুলি নিয়ে এ বার আমের মেলা বাঁকুড়া জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম প্রাঙ্গণে৷ ২৯ মে তার সূচনা করলেন মুনমুন সেন৷ মোট দশটা স্টলে আম্রপালী আর মল্লিকা, এই দুই জাতের আমের প্রদর্শনী ও বিক্রি চলবে ২০ জুন পর্যন্ত৷
কিন্তু বাঁকুড়ার আম টেক্কা দিতে পারবে মুর্শিদাবাদী কৌলিন্যের সঙ্গে?
‘‘টেক্কা দেওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু আমের জগতে নবীন প্রজন্মকেও তো স্বাগত জানাতে হবে৷ মুর্শিদাবাদ-মালদহে বড় জোর দশ দিনের বেশি আমের মেলা হয় না, বাঁকুড়ায় হচ্ছে একুশ দিনের’’— বললেন এই উদ্যোগের সরকারি কর্তা বাবুলাল মাহাতো৷
তা ভাল৷ সে কালে আম খাওয়া ও খাওয়ানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত৷ কল্যাণী দত্ত তাঁর থোড় বড়ি খাড়া-য় জানিয়েছেন, এমনকী খাইয়ের চোখ বেঁধে আম চেনার প্রতিযোগিতাও চলত৷ এ বার না হয় আম ফলানোরও সুস্থ প্রতিযোগিতা হোক৷ তাতে আখেরে লাভ তো আম্ররসিকদেরই৷ সঙ্গে আম খাওয়ার প্রতিযোগিতার ছবি, থোড় বড়ি খাড়া-র (থীমা) পূর্ণেন্দু পত্রী-কৃত অলংকরণ থেকে৷
সুজন সখী
চোখে চশমা, হাতে ঘড়ি/ পরনেতে ঢাকাই শাড়ি/ ভাদু চড়ে রেলের গাড়ি।... ক’দিন ধরেই গাঁয়ের পুকুরপাড়ে ভিড় জমে উঠছিল। অসময়ে ভাদুনাচ দেখে অবাকই হচ্ছিলেন বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের উঁচপুর গ্রামের মানুষ। সবার মুখে একটাই রব, ‘শুটিং লেগেচে’! আগেকার দিনের থিয়েটারের মতো বীরভূমে ভাদু নাচে এখনও ছেলেরাই মেয়ে সাজে। ওই শিল্পীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসেন। কিন্তু, সমাজে আজও অপাংক্তেয় হয়ে আছেন ভাদু বা নাচনি সাজা ব্যক্তিরা। কখনও কখনও সামাজিক বয়কটের শিকারও হতে হয়। লজ্জায় অপমানে আত্মঘাতী হয়েছেন, এমন শিল্পীর খোঁজও মেলে। সেই অবহেলিত নাচনিদের নিয়ে একটি ‘ডকু ফিচার’ বানাচ্ছেন উঁচপুর গ্রামেরই যুবক দেবগোপাল মণ্ডল। তারই শুটিংয়ে যোগ দিয়েছেন আমচুঁয়া গ্রামের ‘সুজন সখী’ ভাদু সম্প্রদায়। এই ভাদু শিল্পীদের জীবনযাপনের সংকটের ছবিটাই বহির্জগতের কাছে মেলে ধরতে চান নবীন এই পরিচালক।
অবসরে কবিতা
কবিতা থেকে মিছিলে পাওয়া গিয়েছে অনেককেই৷ কিন্তু মিছিল থেকে কবিতায়? হাল আমলে নজির কম৷ বঙ্গীয় রাজনীতিতে পদাক্রান্ত সাহিত্য-সঙ্গীত বড়ই বেশি৷ কেউ কেউ দীর্ঘকাল রাজনীতি করে আপাতঅবসরে মন দিয়েছেন পুরনো প্রেম কবিতায়৷ যেমন বিশ্বনাথ কয়াল৷ পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের পশ্চিমাঞ্চল শাখার সভাপতি ছিলেন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে৷ এক সময়ে সম্পাদনা করেছেন ‘গঙ্গোত্রী’ পত্রিকা৷ এখন পুরোদস্তুর কবিতামগ্ন৷ বাঁকুড়া রামানন্দ কলেজে অধ্যাপনা করতেন৷ ঘনিষ্ঠ ছিলেন কবি দিনেশ দাসের৷ সেই কাস্তেকবিকে নিয়ে গবেষণা করছেন৷ সম্প্রতি প্রকাশিত হল তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ এখন সময় (শ্লোক)৷ এ যুগে চাঁদ নয়, তবে কি অবসরই কাস্তে?
পাঁচের দশ
অর্পণ, মিতালি, দেবব্রত, বিজয় এবং অজয়— বিভিন্ন বয়স। গল্প বলার ধরনও ভিন্ন। পাঁচ গল্পকারের মধ্যে বুনন একটাই, সাইঁথিয়া। বীরভূমের ওই প্রান্তিক মফস্সল থেকে উঠে আসা পাঁচ গল্পকারের দশটা গল্প নিয়ে সঞ্জীব ভট্টশালীর সম্পাদনায় বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে গল্প সংকলন পাঁচকাহন (সঞ্জীব প্রকাশন)। গল্প বলার ধরনের বৈচিত্র্যটুকুই সংকলনে প্রাপ্তি। উল্লেখ করতে হয় অর্পণের গল্প দু’টির। তাঁর শব্দচয়ন জানায়, গদ্যের আড়ালে তিনি কবিতা লেখেন। না হলে তাঁর চরিত্রেরা কি প্রশ্ন করতে পারেন— ঊর্ধ্বের কি সীমানা আছে ইন্দ্র!
আবার ইঁদুর
বাংলা সাহিত্যে জৈনধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর গবেষণা স্মরণীয় হয়ে আছে৷ বরিশালের ‘ছাওয়াল’ তপন চক্রবর্তী শেষ পর্যন্ত নীড় বেঁধেছিলেন বর্ধমানের মায়াডোরে৷ গবেষণার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন৷ কিছু কাল আগে প্রয়াত এই কবির একদা আঞ্চলিক কবিতায় সাড়া-জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘ইঁদুর-দৌড়’ (বাকচর্চা) নতুন করে প্রকাশিত হল তাঁর মৃত্যুর পরে৷ সব লেখাই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁর মেয়ে মঞ্জরিতা চক্রবর্তী৷ তপনবাবুর ব্যক্তিগত গ্রন্থসংগ্রহটিও তিনি দিয়ে দিতে চান কোনও প্রতিষ্ঠানকে৷
সাগর-ধর
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “তাঁর গল্পে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। গ্রামবাংলা ও সেখানকার মানুষজন তাঁর লেখায় অনায়াসে প্রাণ পেয়েছে। তাঁর শিল্পবোধ আছে। দেখার চোখ আছে। হৃদয়বত্তা আছে।” বাস্তবিকই, সাগরের ভূমিপুত্র ভাগ্যধর বারিকের গল্প-উপন্যাসে জীবনের ছোট ছোট পাওয়া না-পাওয়াগুলো যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। আজীবন লিখে গিয়েছেন ‘বিভু নাগেশ্বর’ ছদ্মনামে। আশির দশকে ত্রৈমাসিক ‘সাগরিকা’ পত্রিকায় লেখা শুরু। পরে নিজেই ‘সাগরবেলা’ নামে প্রত্রিকা সম্পাদনা করেন। সেখানেই তাঁর প্রথম উপন্যাস, ওড়িয়া-বাংলা মেশানো সাগরের কথ্য ভাষায় লেখা ‘মায়া গোয়ালিনীর ঘাট’ ধারাবাহিক ভাবে বেরোয়। পরে একে একে লেখেন ‘হারিয়ে খুঁজি’, ‘স্রোতের টানে’, ‘লোনামাটির স্বাদ ও কল্যাণী’, ‘হেমাঙ্গশেখর’, ‘দিনকাল’, ‘সমদ্দুরের ডাক ও ভাঙা নৌকার যাত্রী’, ‘নীড় খোঁজে পাখি’ প্রভৃতি উপন্যাস। গল্প সংকলন ‘শেষ দৃশ্যের পরে’। সম্প্রতি ‘এক ছবিতে দু’টি মুখ’ নামেও একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ২০০১ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সংস্কৃতি পরিষদ তাঁকে সম্মানিত করে। ওই বছরেই ‘পেন, পশ্চিমবঙ্গ’ থেকে সম্মানিত হন। গত বছর গ্রামীণ সাহিত্য পরিষদ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু আসল পুরস্কার তিনি পেয়ে গিয়েছেন পাঠকের ভালবাসায়। সত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটির কলম আজও সমান সচল।