যেন ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে। কিছুতেই ওঁদের আর কোনও উৎসাহ নেই।
আজ, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য উঠছে সিঙ্গুর মামলা। রায়ও হয়ে যেতে পারে। অথচ যাঁরা এক দিন জমিরক্ষা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন, সেই ‘অনিচ্ছুক’ চাষিরাই এখন জমি ফেরত নিয়ে কথা বলতে সবচেয়ে অনিচ্ছুক।
যে জমি এক সময়ে সোনার ধান ফলাত, সব ঠিকঠাক চললে ন্যানো গাড়ি ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল যে জমিতে, চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠার কথা ছিল অনুসারী শিল্প, সেখানে বিঘের পর বিঘে জুড়ে মাথা দোলাচ্ছে কাশবন। যাঁরা শিল্পের জন্য জমি দিয়েছিলেন, সেই ইচ্ছুক চাষিদেরও অনিচ্ছুকদের সঙ্গে কার্যত এক সরলরেখায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে শিল্প না হওয়ার হতাশা।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধার ঘেঁষে টানা পাঁচিলে ঘেরা সেই জমি চাষিদের ফিরিয়ে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারে এসেই রাতারাতি নতুন আইন করে জমির দখল নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েই মামলা ঝুলছে আদালতে। জনহীন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু টাটা গোষ্ঠীর গাড়ি কারখানার কঙ্কাল।
(বাঁ দিক থেকে) জয়দেব ঘোষ (ইচ্ছুক চাষি), নবকুমার ঘোষ (অনিচ্ছুক চাষি),
পাঁচুগোপাল ঘোষ (অনিচ্ছুক চাষি), রামচন্দ্র বাগুই (অনিচ্ছুক চাষি)। ছবি: দীপঙ্কর দে
একদা সিঙ্গুর আন্দোলনের ধাত্রীভূমি গোপালনগরে বাস নবকুমার ঘোষের। জমিরক্ষার আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। প্রকল্প এলাকায় তাঁর দশ বিঘে জমি ঢুকে গেলেও চেক নেননি। যাঁর বাড়িতে গোলা ভরা ধান ছিল, এখন তিনিই রাজ্য সরকারের দেওয়া দু’হাজার টাকা অনুদান আর মাসিক ১৬ কিলো চালের মুখাপেক্ষী। এক সময়ে তিনি নিজে গোপালনগর পঞ্চায়েতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য ছিলেন, এখন তাঁর স্ত্রী ওই পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা।
সোমবার সেই নবকুমারবাবুর গলায় ঝরে পড়ল আক্ষেপ “ভুল করেছি সে সময়ে টাকা না নিয়ে। কখনও শুনিনি, জমি অধিগ্রহণের পর কেউ তা ফেরত পেয়েছে।” এক দিন যাঁদের নেতা-নেত্রী মনে করতেন, এখন তাঁদের সম্পর্কেই তাঁর গলায় একরাশ তিক্ততা “আমরা আন্দোলন করলাম আর মমতা দিদি, বেচারাম, রবীনবাবুরা (সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) রাজত্ব পেলেন হাতে। আমরা কী পেলাম? যে গরিব ছিলাম, তার চেয়েও খারাপ হয়ে গেলাম!”
ঘোষপাড়ার পাঁচুগোপাল ঘোষের চার বিঘে জমি রয়েছে প্রকল্প এলাকায়। তৃণমূল ও তার সরকারের নেতা-কর্তাদের মুখে লাগাতার আশ্বাস শুনে-শুনে এখন তিনি বিরক্ত। জমির কথা উঠতেই ঝেঁঝে ওঠেন “আর নয়! অনেক হয়েছে। গত আট বছর ধরে অনেক শুনেছি। রাজ্য সরকার আগে আমাদের জমি ফেরত দিয়ে নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুক!”
হতাশা চাপতে পারছেন না জমি দিয়ে চেক নেওয়া চাষিরাও। বাম সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে টাটা গোষ্ঠীর গাড়ি কারখানার জন্য ১২ বিঘে জমি দিয়েছিলেন জয়দেব ঘোষ। তাঁর আক্ষেপ, “বাম সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কারখানা করতে পারল না। নতুন সরকার জেদ ছেড়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করল না! সেই সময়ে টাকা নিয়েছিলাম বলে বেঁচে গিয়েছি।” তাঁর কটাক্ষ, “শিল্প হলে কত ছেলের চাকরি হত। মুখ্যমন্ত্রী সে দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না, আর শিল্প আনতে বিদেশ যাচ্ছেন!” এক সময়কার অনিচ্ছুক চাষি রামচন্দ্র বাগুই প্রশ্ন তুলছেন, “যদি কোর্ট রায়ও দেয় যে চাষিদের জমি ফেরাতে হবে, ওই জমি নিয়ে কী হবে? কংক্রিট, ঝোপ-জঙ্গলের নীচে সব ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ও কি চাষের কাজে লাগানো যাবে?” আগের অবস্থান থেকে সরে এসে তাঁর সিদ্ধান্ত, “জমি আর চাই না। গত আট বছরের ক্ষতিপূরণ-সহ টাকা পেতে চাই।”
সিঙ্গুর আন্দোলন থেকে ক্ষমতার অলিন্দে উঠে আসা নেতা, রাজ্যের কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না অবশ্য দাবি করছেন, “আন্দোলনে ছিলেন, এমন কেউ এ কথা বলতে পারেন না। কাগজওয়ালারা তো জমিদাতা বলে অনেকেরই কথা-ছবি ছাপছে, এই প্রকল্প এলাকায় যাঁদের জমি নেই, আন্দোলনেও ছিলেন না। সুপ্রিম কোর্ট গরিবের পক্ষে রায় দেবে বলেই দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি আমরা। ”
এই সব কথা সিঙ্গুরের বেশির ভাগ মানুষই আর শুনতে চাইছেন না। ইচ্ছুকও না, অনিচ্ছুকও না।