রাজীব কুমার, জাভেদ শামিম, (নিচে) কঙ্করপ্রসাদ বারুই ও তন্ময় রায়চৌধুরী।
‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র গল্পে রাজকুমার বুদ্ধুর প্রশ্নে রাজকন্যা কলাবতী বলেছিল, ‘আগে ছিলাম বাপ-মায়ের, এখন যে তোমার।’ আইপিএস অফিসারদের একাংশের মনোভাবও পরিষ্কার— ‘আগে ছিলাম সিপিএমের আর এখন প্রবল ভাবে মমতার।’ আর ভোটের আগে তেমন কয়েক জনকে নির্বাচন কমিশন বদলি করতে পারে বলে পুলিশেরই একটি সূত্রের খবর।
এঁদের কেউ নিখুঁত অপারেশনের মাস্টার। তাতে ঘুষ নিতে গিয়ে কোনও সরকারি কর্তা বমাল গ্রেফতার হন কিংবা দাগি দুষ্কৃতী ধরা পড়ে ঠিকই। আখেরে সুবিধে হয় শাসক দলের। কেউ কেউ আবার ভোটের দিন শাসক দলের বহিরাগত বিধায়ক ও তাঁর বহিরাগত সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে খোশগল্পে মশগুল থাকেন। ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, অন্য এলাকার লোক এল কেন— সেই প্রশ্নও তোলেন না। একদা সিপিএমের মার্কামারা হিসেবে পরিচিত এক জন এসপি আবার এখন তাঁর মোবাইলে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর ফোন এলে স্পিকার অন করে অন্যদের শোনান। এমনও বলে বেড়ান, ভোট মিটে গেলে প্রোমোশন পেয়ে তিনিই প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের ডিআইজি হচ্ছেন।
এই সব অফিসারদের দিয়ে ভোট করালে নির্বাচন কমিশন যতই কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাক, ভোট মোটেই পরিচ্ছন্ন হবে না বলে দাবি বিরোধীদের। এক বিরোধী নেতা বলেন, ‘‘শাসক দলের বশংবদ হিসেবে তাঁদের আচরণের কিছু দৃষ্টান্ত আমরা কমিশনের কাছে তুলে ধরেছি।’’
সল্টলেকে পুরভোটের দিন বহিরাগত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে তাঁদের দুই নেতা তথা শাসকদলের দুই বিধায়কের সঙ্গে বিধাননগর কমিশনারেটের ডিসি (ডিডি) কঙ্করপ্রসাদ বারুই ও অতিরিক্ত ডিসি দেবাশিস ধর গল্প করছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে পুলিশি মদতেই বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য চরমে ওঠে বলে জানান বিরোধীরা। কঙ্করপ্রসাদ কিন্তু এখন এমনিতে আইবি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট, তবে সেখানে না গিয়ে বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান পদে ডেপুটেশনে রাখা হয়েছে তাঁকে। বিরোধীদের বক্তব্য, বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিমের বিরুদ্ধে শাসক দলের হয়ে খুল্লমখুল্লা সমর্থনের অভিযোগ আনা হয়তো যাবে না, কিন্তু বিধাননগর ভোটে যা হয়েছিল, তাতে সিপি হিসেবে তিনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কাজেই, জাভেদকেও অন্যত্র সরানো উচিত বলে দাবি বিরোধীদের একাংশের।
তবে বিরোধীদের অনেকেরই বেশি ভয় কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনারকে নিয়ে।
গত বছরের ঘটনা। ভোটের আগে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে যে সরতেই হচ্ছে, সেটা তত দিনে স্পষ্ট। বাহিনীর একটা বড় অংশ সৌমেন মিত্রকে সিপি হিসেবে চাইছে। সেই সময়ে লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘বাহিনী চাইলেই তো আর হবে না। সৌমেন মিত্রকে সিপি করে বিধানসভা ভোটে গেলে শাসক দলের ঝুঁকি হয়ে যাবে। ওঁকে দিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করানো একটু মুশকিল।’’
২৯ জানুয়ারি সরকারি বিজ্ঞপ্তি বেরোয়, কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনার হচ্ছেন রাজীব কুমার। যাঁর সম্পর্কে বিরোধীদের অভিযোগ, তিনি সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট-এর অন্যতম সদস্য হিসেবে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি লোপাট করে দিয়েছেন, যা সামনে এলে শাসক দলের বহু নেতা-নেত্রী ফেঁসে যেতেন। এমনকী, সুরজিৎবাবুর উত্তরসূরি কে, তা নিয়ে যখন জল্পনা তুঙ্গে, সেই সময়ে শাসক দল ও নবান্নের একটি অংশ তৎপরতার সঙ্গে প্রচার করে, ভোটের মুখে কলকাতার সিপি-কে ডেকে সিবিআই বা ই়ডি জেরা করলে তা কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। তবু সে সব পাত্তা না দিয়ে রাজীব কুমারকে সিপি করা হয়।
অথচ এই রাজীব কুমারের বিরুদ্ধেই বাম জমানায় তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, তিনি নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনে আড়ি পাতেন। সেই সময়ে বামেদের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তন্ময় রায়চৌধুরী এখন উত্তর ২৪ পরগনার মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলার পুলিশ সুপার। নন্দীগ্রামের গুলি চলার ঘটনায় যে সব পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূল, তাঁদের অন্যতম এই তন্ময়বাবু। পালাবদলের পরে এখনকার শাসক দল ও সরকারের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথাও ক্ষমতার অলিন্দে মুখে মুখে ফেরে। তেমনই কলকাতা পুলিশের দু’জন ডিসি রোজ নিজের নিজের এলাকার যাবতীয় রাজনৈতিক খবর, এমনকী তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের কার্যকলাপ পর্যন্ত শাসক দলের শীর্ষ মহলে পৌঁছে দেন। বলে বেড়ান, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হটলাইনে।
এক বিরোধী নেতার বক্তব্য, দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে প্রবল গণ্ডগোল হয় কাশীপুর এলাকায়। সেই সময়ে ডিসি (নর্থ) ছিলেন যিনি, সেই গৌরব শর্মা এখন দক্ষিণ-পূর্ব ডিভিশনের ডিসি। কাশীপুরের গণ্ডগোল ডিসি হিসেবে থামাতে তিনি ব্যর্থ হন। ওই নেতার কথায়, ‘‘ডিসি (বন্দর) সুদীপ সরকার ও দক্ষিণ পশ্চিম ডিভিশনের ডিসি রশিদ মুনির খানও শাসক দলের শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠ বলে আমরা জেনেছি। এঁদের সকলের বিরুদ্ধেই তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাব।’’
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী মঙ্গলবার বলেন, ‘‘কয়েক জন অফিসারের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নিজস্ব সূত্রেও খবর পাচ্ছে। কয়েক জনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’