সময়টা ১৫ আশ্বিন, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোগশয্যায়। একটু হলেও তাঁকে তৃপ্তি দিল ‘ল্যাবরেটরি’। প্রকাশিত হয়েছে শারদীয়া ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। পত্রিকাটি বাবার কাছে নিয়ে গেলেন রথীন্দ্রনাথ। ডাক্তারের নিষেধ রয়েছে, তবুও লেখায় আগাগোড়া চোখ বোলালেন তিনি।— ‘তৃপ্তি’ পেলেও পুজোয় লেখা দেওয়ার তাগিদ বা তাড়া রবীন্দ্রনাথের কোনও কালেই পিছু ছাড়েনি।
ঠিক এক বছর আগের ঘটনা। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ। আশি-ছুঁইছুঁই রবীন্দ্রনাথ। রয়েছেন মংপুতে। পাহাড়ের কোলে সূর্য ডুবুডুবু। সে দিকে নজর নেই রবীন্দ্রনাথের। ঘাড় গুঁজে লিখেছেন, গল্প। কেউ তাড়া দিলেই তাঁর এক কথা, সময়মত লেখা পাঠাতে হবে শারদীয়ার জন্য। তা তিনি পাঠালেনও। তাই সে বছর শারদীয়া আনন্দবাজার প্রচ্ছদেই জানান দিল, রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন বড় গল্প’ ‘রবিবার’-এর দেখা মিলবে পত্রিকার পাতা ওলটালেই।
তবে পুজোর লেখা নিয়ে বিব্রতও হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৮ সালে কবির জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পুজো উপলক্ষে একটি সাহিত্য-সংকলন প্রকাশ করেন। নাম, ‘পার্বণী’। তাতে লেখা দেওয়ার অনুরোধ এল। রবীন্দ্রনাথ সটান বললেন, ‘‘কোনো রকম লেখা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব।’’ শেষমেশ অবশ্য লেখা দিয়েছিলেন।
লিখতে লিখতে ‘পুজোর ছুটি’তে রবীন্দ্রনাথের নিজের ঘরের আপনজনটির জন্যই সময় থাকত না। এক বার তো তিনি নিজেই কুষ্টিয়া থেকে এক চিঠিতে আক্ষেপ করেন, ‘‘বাড়ির লোকটি আমার সমস্ত খাতাপত্র কেড়েকুড়ে নিয়ে বলছে, তুমি কাজ ঢের করেছ, এখন একটুখানি থামো।’’
লেখক রবীন্দ্রনাথ যতখানিই বিব্রত বা তৃপ্ত হোন না কেন, পুজোর লেখা নিয়ে তাঁর সম্পাদক সত্তা কিন্তু বিশেষ যত্নশীল ছিল। তাই, তাঁরই নির্দেশে ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যা একসঙ্গে মোটা কলেবরে বের হয়।
তবে এমন ‘যত্ন’ নিতে নিতে শরৎপ্রকৃতির আস্বাদগ্রহণ আর হয়ে ওঠে না সম্পাদকদের। ‘দেশ’ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে তাই এই সময়টা ‘রস-কষ হীন’। আর তার প্রধান কারণ, হরেক চরিত্রের লেখকদের থেকে লেখা আদায় করা। সঙ্গে বাড়তি উৎকণ্ঠা, পত্রিকা প্রকাশের ‘ডেডলাইন’-এর লক্ষ্মণরেখা।
আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখকরা থাকলে যে কোনও সম্পাদকের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ারই কথা। শারদীয়ার লেখা আদায় করতে প্রেমেন মিত্তিরের বাড়িতে গিয়েছেন এক নামজাদা পত্রিকার সম্পাদক। করুণ ভাবে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বললেন, ‘‘ছয় বছর ধরে আপনি আমাকে লেখা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরাশ করেছেন। এ বছর ছাড়ছি না।’’ উত্তরে লেখকের চটজলদি জবাব, ‘‘প্রত্যেক বছরই তোমাকে লেখা দেব বলে ভাবি। কিন্তু এ বার বোধ হয় ভাবতেও পারব না।’’
সম্পাদক সাগরময়বাবুও একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লেখা কদ্দূর, খোঁজ নিতে গিয়েছেন প্রেমেন্দ্রবাবুর বাড়িতে। সাগরময়বাবু ঘরে ঢুকতেই পূর্ব দিকের জানলাটা তিনি লক্ষ করেছেন কি না, জানতে চাইলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সাগরময়বাবুর কাছে ইতিবাচক উত্তর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী লেখক বললেন, ‘‘তোমাকে মামলায় সাক্ষী দিতে হবে।’’ আর লেখা?— সম্পাদকের কথা শুনে চিৎকার করে উঠলেন লেখক। পড়শির সঙ্গে জানলা-দেওয়াল সংক্রান্ত মামলা চলাকালীন লেখা চাওয়াটাই অপরাধ, মত প্রেমেন্দ্রবাবুর!
এক বার নাকি সম্পাদককে বাগবাজারের বাড়িতে ডেকে নিজের পেটের এক্স-রে প্লেট দেখিয়ে তারাশঙ্কর প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি অসুস্থ। তাই পুজোর লেখা দিতে অপারগ।
তবে সব ক্ষেত্রেই এমনটা ছিল না। অনেক লেখকই ছিলেন, যাঁরা পুজোর লেখা ভীষণ পছন্দ করতেন। তেমনই দু’জন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর বন্ধু নরেন্দ্রনাথ মিত্র। পুজোয় কে ক’টা গল্প লিখতে পারেন, সে নিয়ে দু’জনে প্রতিযোগিতায় নামতেন। এক বার পুজোয় নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখার পরিমাণ নিয়ে ঘরোয়া আলোচনা চলছে সাহিত্যিক মজলিসে। হঠাৎ ঢুকলেন লেখক। সব শুনে নরেন্দ্রনাথবাবুর আক্ষেপ, ‘‘আমার লেখার বায়না রয়েছে অষ্টমী পর্যন্ত। আর নারানের বিসর্জনের দিন পর্যন্ত!’’
পুজোর লেখার কয়েক মাস আগে হঠাৎ ‘লেখা আসছে না’ বলে মনখারাপ নরেন্দ্রনাথবাবুর। দিন কয়েক এমনটা চলার পরে ফের লেখা এল। স্ত্রী শোভনাকে ডেকে বললেন, ‘‘বলা যায় না হয়তো এটা একটা গ্রেট উপন্যাস হয়ে যেতে পারে।’’ স্ত্রী বললেন, ‘‘তা হলে লেখো না! এ বার বরং পুজোর লেখা বন্ধ রেখে এই উপন্যাসটিই শেষ করো।’’ কিন্তু নরেন্দ্রনাথের জবাব, ‘‘তাই কখনও হয়! পুজোর লেখার আনন্দই যে আলাদা। তোমরা যেমন পুজোয় নতুন জামাকাপড় পরে, অন্যকে দিয়ে আনন্দ পাও, আমরা লেখকরা তেমনি পুজোয় নতুন লেখা পাঠকদের দিয়ে আনন্দ পাই।’’
পাঠকরা আনন্দ পান নতুন, কালজয়ী লেখা এবং অবশ্যই নবীন লেখকদের হদিশ পেয়ে। যেমন, ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গবাণী’র পুজো সংখ্যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘মহেশ’ গল্পটি। তেমনই, অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘দিগন্ত’ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সন্তোষকুমার ঘোষের ‘কিনু গোয়ালার গলি’। এ ছাড়া ‘প্রসাদ’, ‘নারায়ণ’, ‘বিজলী’, ‘প্রবাসী’, ‘যমুনা’, ‘ভারতী’, ‘বসুমতী’, ‘এক্ষণ’-সহ নানা পত্রিকার পুজো সংখ্যাগুলিও ছিল নজরকাড়া।
অন্তত দু’জন লেখকের নাম না করলেই নয়, যাঁদের উপন্যাস-শিল্পী হিসেবে ‘ডেবিউ’ এই পুজো সংখ্যাতেই। প্রথম জন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তখন তরুণ বয়স তাঁর। সুশীল রায়ের বাড়িতে জমজমাট সান্ধ্য আড্ডা চলছে। সেখানেই সাগরময় ঘোষ উপন্যাস লেখার জন্য বললেন সুনীলকে। অগাধ জলে পড়লেন যেন তিনি। লিখবেনটা কী নিয়ে! মনে পড়ল জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’ বইয়ের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্লট খুঁজতে হয় না। জীবনের কোনও একটা ঘটনার কথা মনে করি।’’ সুনীলও সেই পথ অনুসরণ করলেন। জন্ম হল ‘আত্মপ্রকাশ’-এর। পুজো সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘গা ঢাকা’ দিলেন সুনীল। কিন্তু প্রশংসাই জুটল আবু সৈয়দ আইয়ুবের মতো পাঠকের কাছ থেকে।
অন্য লেখকটি, নবনীতা দেবসেন। ১৯৭৬ সাল। তখন তিনি পদ্যে বেশ পোক্ত। হঠাৎ একটি চিঠি পৌঁছল তাঁর কাছে। লিখেছেন রমাপদ চৌধুরী, উপন্যাস চেয়ে। তরুণ নবনীতার মনে হল, এ যেন ‘লেখার আগেই জ্ঞানপীঠ পেয়ে যাওয়া।’ লিখলেন তিনি। জন্ম নিল, ‘আমি, অনুপম’। জন্ম নিলেন উপন্যাসশিল্পী নবনীতাও। ‘দেশ’ পুজো সংখ্যায় জন্ম বাঙালির প্রিয় ফেলু মিত্তিরেরও।
পুজো সংখ্যা নয়, কিন্তু পুজোর বই হিসেবে জীবনে ‘রং’ এনেছিল বটতলার কিছু বই। সেগুলির দাম ছিল এক পয়সার মতো। পুজো মানেই পকেটে টান, এই বিষয়টি নিয়ে নানা তামাশা করা হত সে সব বইয়ে। একটি বইয়ে যেমন লেখা, ‘এ বার পূজায় বিষম দায়/ বউ পাঁচশো টাকা চায়/ .....বাবু হাবুডুবু খায়।’
পুজোর লেখা এ ভাবেই আনন্দের রসদ জুগিয়ে চলেছে। আজও।