গোটা পৌষ মাসটা যা গেল, মনে তো হচ্ছে না এই মাঘের শীতে বাঘ তো দূরের কথা, খরগোশও পালাবে বলে! তবুও, শীতের সময় ছাড়া এত ঝকঝকে, টাটকা আর উজ্জ্বল রঙে-ভরা বাজার বছরের অন্য কোনও সময় দেখতে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। সবুজ যে এত রকমের হতে পারে তা এই সময়ের বাজার ভালই প্রমাণ দেয় । সকাল সকাল গলায় ছাইরঙা মাফলার আর গায়ে লাল-কালো সোয়েটার চাপিয়ে (চাদর নিলে, নিচু হয়ে সব্জি বা মাছ বাছার সময় বাইচান্স ধারগুলোয় কাদা লেগে যেতে পারে) নাইলনের ব্যাগ হাতে বাজারে ঢোকবার মুখেই বেগুনের স্তূপে চোখ আটকে যায়। এই সময় যেমন গাঢ় বেগুনি আর সাদাটে দু-ধরনেরই বেগুন উঠে থাকে। আর আসে সাদাটে সবুজ রঙের একদম গোল আর বোঁটায় কাঁটাওয়ালা মাকড়া বেগুন। হাতে নিয়ে হালকা কি না দেখে, চাপ দিয়ে আঙুল বসে যাচ্ছে না বুঝে নিয়ে, মনে মনে সেটি ছাঁকা তেলে কলকলে করে ভাজা হলে গরম গরম খাস্তা পরোটা দিয়ে মুড়িয়ে তার সঙ্গে এক-এক কামড় ঝাল লঙ্কা কামড়ে কামড়ে খেতে কেমন লাগবে তা ভাবতে ভাবতে আনমনে সেগুলো বাজারের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতে হয়।
বেগুনের পরেই চোখে পড়বে ছোট ছোট দিশি ধনেপাতার সবুজ গোছা। একটা গুছি হাতে তুলে নিয়ে তার একটি পাতা দু-আঙুলের মধ্যে সামান্য ডলে, নাকের কাছে সুন্দর গন্ধটি পাওয়া যাচ্ছে কি না তা দেখা আর সেইসঙ্গে পাশের ডালার সাধারণ হাইব্রিড লঙ্কার পাশে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা বিষের মতো ঝাল ছোট্ট ছোট্ট ধানিলঙ্কাদের একটিকে সামান্য দাঁতে কেটে হু-হা করতে করতে দর করে নেওয়া। মুখটা একটু জুড়োলেই নজর পড়বে পাশের চাচার কাছে সাজিয়ে রাখা দিশি পেঁয়াজকলির গোছার দিকে। এই কলিরা একদম ছোট্ট ছোট্ট। মাথার ফুলগুলি কারওরই ফোটা নয়। গোড়ার কাছটিও গাঢ় সবুজ, মোটেই চালানি বা পাকা পেঁয়াজকলির মতো ফ্যাকাসে সবুজ বা হলদেটে নয়। বিকেলের দিকে মুড়ি-কড়াইশুঁটির সঙ্গে কামড়ে কামড়ে কুচমুচ করে খেতেও ভারী ভাল লাগে।
এই রে! কড়াইশুঁটি কোথায় ? তাড়াতাড়ি এ বার কড়াইশুঁটির ডালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। পাশাপাশি দু’জন ব্যাপারীর ডালায় নাসিকের চকচকে তেলা গায়ের স্বাস্থ্যবান কড়াইশুঁটি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে মডেল গার্লদের মতো সরু ছিপছিপে লম্বা লম্বা আর মিষ্টি দানার চন্দনেশ্বর থেকে আসা দিশি কড়াইশুঁটি। দ্বিতীয়টি দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট গোল নতুন আলুর শুখা আলুদ্দম আর ওপরে সামান্য কুচনো ধনেপাতা— আহা! ঠিক যেন বিভূতিভূষণের কোনও ছোটগল্প। এ বার গুটি গুটি পায়ে সরে যেতে হয় নতুন আলুর দিকে। চন্দ্রমুখীর একদম গুঁড়ি গুঁড়ি সাইজের আলুগুলি আসতে শুরু করে দিয়েছে তারকেশ্বর থেকে। তাদের গায়ে সামান্য সবুজ ছোপ আছে কি না দেখে নিয়ে, বেছে বেছে একটি একটি করে রসমুণ্ডির মতো তুলে নিতে হবে বেতের ঝুড়ি থেকে। বিকেলবেলায় এদের কড়াইশুঁটির সঙ্গে সেদ্ধ করে সামান্য নুন-মরিচ-লেবুর রস ছড়িয়ে দিলেই অসামান্য। সঙ্গে দু-এক কুচি গাজর পড়লে তো সোনায় সোহাগা।
শীতের বাজারেই আসে টুকটুক লাল জয়পুরি গাজর। গা-টা এমন পেলব আর সরেস যে বলার নয়। ভাল করে ধুয়ে নিয়ে শুধু মুখে কামড়ে কামড়ে খেতেও ভাল লাগে। পাশাপাশি, কমলা রঙের একটু শক্ত গায়ের দিশি গাজরও রয়েছে, কিন্ত ও দিকে এখন নজর না-দিলেও চলবে। বরং তার গা-ঘেঁষে কালচে-লাল রঙের যে দিশি গোল ছোট্ট ছোট্ট বিট— তাদের গরম গরম হাতরুটি দিয়ে খেতে খেতে একটু আলাদা করে ভালবাসা যায়। বেচারারা সেই হাসনাবাদ থেকে কোন ভোরে ট্রেন ধরে আমাদের কাছে এসেছে। শুঁটি, বিট আর গাজর দিয়ে একটি চমৎকার ঝোলঝোল তরকারি হয় এই শীতকালেই আর ভেজিটেবল-চপ হলে তো কথাই নেই। লাল টুকটুকে গায়ের পাতলা খোসার শির টানাটানা টমেটো চলে এসেছে বেঙ্গালুরু থেকে। তারই পাশাপাশি বাংলার ফিকে সবুজরঙা টকটক টমেটো। শীত ছাড়া এদের টিকিরও দেখাও পাওয়া যায় না। আদাকুচি, ধনেপাতা আর চিনি দিয়ে এদের হাতচাটনিই হোক বা অন্য যে কোনও ব্যঞ্জন— তা একটা অন্য মাত্রা পাবেই পাবে।
আর রয়েছে পাতলা ছোট্ট ছোট্ট পাতার কিশোরী পালংশাক। গোড়াগুলো এত কচি যে বলার নয়। কচি কুমড়ো, বিউলির ডালের বড়ি, সাদা তুলোর মতো গোলাপি আভা খেলা শীতকালের দিশি মুলো সহযোগে বানানো তরকারিটি গরম ভাতে মেখে মুখে তুললে চিরজীবন মনে লেগে থাকে। দিশি ছোট ছোট ফুলকপি, যার ফুলটি একটু ছাড়া ছাড়া আর মাথার ওপরটা একটু গুঁড়ো গুঁড়ো মতো, তা দিয়ে চমৎকার কপিভাজা, যা সোনামুগডাল দিয়ে লম্বা লম্বা বাঁশকাঠি চালের ধোঁয়া-ওঠা ঝরঝরে গরম ভাত মেখে খাওয়ার সময় টাকনার মতো মুখে দিতে অপূর্ব লাগে। আবার ফুলগুলোর মাথা একটু জোড়া লাগা-লাগা নাসিকের কপি, যা কি না স্নো-বল নামেই বাজারে বেশি প্রচলিত, সে-ও আসতে শুরু করে এই শীতের বাজারেই। ছোট গোটা গোটা দেশি ভেটকি বা বাগদা চিংড়ি সহযোগে এই ফুলকপির ঝোল অতি উপাদেয়। এই শীতের বাজারেই নানা ধরনের ছোটমাছ, যাদের বর্ষাকাল ছাড়াও এই সময়টিতেও দ্বিতীয় বার ডিম হয়, বাজার প্রায় ছেয়ে ফেলে। ডিম ভরা রুপোলি দিশি পার্শে, গুলসে বা সোনালি গায়ের দিশি ট্যাংরা, ছোট ছোট রং-ছাড়া দেশি পাবদা— যাদের অল্প করে ঘানির সরষের তেলে এ পিঠ-ও পিঠ করে ভেজে নিয়ে শুধুমাত্র কালোজিরে ফোড়ন আর চিরে দেওয়া কাঁচালঙ্কা দিয়ে ফুটিয়ে নেওয়ার পর সামান্য বোনলেস ধনেপাতা ওপরে ছড়িয়ে দিলেই পুরো বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা ছবি।
এই সময় পুকুরের বেলেমাছেরও সাদাসাদা সুস্বাদু ডিম হয়। ডিম হয়— এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসা আশ্চর্য স্বাদের ন্যাদস মাছের পেটে। সামান্য রাইসরষে দিয়ে যাদের ঝাল রাঁধার সময় ওপরে দু’টি যুবতী টমেটো ফাটিয়ে দিলে আলাদা রূপ খোলে। আর ন্যাদসের ঝাল দিয়ে দুপুরবেলায় একথালা ভাত খেয়ে উঠে, তারপর পা-টা পাতলা একটি বালাপোশে ঢুকিয়ে দিয়ে, সত্যজিতের কোনও একটি প্রিয় সিনেমা দেখা— আহা অতুলনীয়! না-চাইতেই শীতকালের বাজার ভরে যায় নানান রকমের চিংড়িতে। হরিণা থেকে চাপড়া, ঘুষো থেকে ডানসিং গলদা— সব কিছুই শীতের বাজারে টাটকা আর ঝকঝকে। আর অবশ্যই ধবধবে সাদা পমফ্রেট— যাদের সাপ্লাই বাড়ে ও দাম কমে একমাত্র এই শীতের বাজারে। ফলের বাজারে টসটস করে ফুলো ফুলো গায়ের পঞ্জাবের বড় বড় কমলালেবু। ছোট সাইজের চিনির মতো মিষ্টি দার্জিলিং এ বার প্রায় অধরাই রইল। ছোট্ট ছোট্ট পানিফলের এখন প্রায় উঠে যাওয়ার সময়। বরং কাশ্মীরী আপেল ছেয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে। কাবুল থেকে আসছে রক্তের মতো লাল লাল কোয়াওয়ালা সামান্য টক-মিষ্টি খান্দেরি-ডালিম। মাথায় মাঙ্কি-টুপি চাপিয়ে বাজারে এসে গিয়েছে জয়নগরের মোয়া আর নাকরি-ভরা টলটলে পয়রাগুড়। সাগরদ্বীপের পাটালির বুকে এখন যেন আকাশের সুগন্ধ।