—ফাইল চিত্র।
ফিল্মি কায়দাতেই ভেঙ্কটেশ ফিল্মসকে হুঁশিয়ারি দিলেন নিতিন গডকড়ী!
তারাতলায় বন্দরের জমি জবরদখল করে বসে থাকা শ্রীকান্ত মোহতার সংস্থাকে উৎখাত করতে তাঁরা যে বদ্ধপরিকর, তা স্পষ্ট করে দিয়ে কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রীর ঘোষণা, ‘‘উনকো উখাড়কর ফেকেঙ্গে... ছোড়েঙ্গে নহি।’’ পাশাপাশি, জমি উদ্ধার করতে যাওয়া কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের (কেপিটি) দলকে সাহায্য না-করায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গডকড়ী। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ পি-৫১ হাইড রোড এক্সটেনশনের জমি দখল করার পরেও ফের তা জবরদখল হয়ে যায়। গডকড়ীর কথায়, ‘‘আমরা পুলিশি নিরাপত্তা চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। দুঃখজনক ঘটনা।’’
চাপের মুখে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস অবশ্য ইতিমধ্যেই ধাপে ধাপে ওই জমি ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর দখল-পুনর্দখল পর্বের পরে ১৭ তারিখ বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে তারা দাবি করে, জমি ঘিরে বিবাদের কথা কিছুই তাদের জানা ছিল না। এলএমজে কনস্ট্রাকশনের কাছ থেকে সরল বিশ্বাসে দু’দফায় মোট ৬৯ হাজার বর্গফুট জমি মাসিক ১২ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিল তারা। ওই জমিতে স্টুডিও গড়তে প্রায় ৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমে বিবাদের পুরো বিবরণ জানার পরে ওই জমি ছেড়ে দিতে চায় ভেঙ্কটেশ। ১৯ হাজার বর্গফুট জমি তারা ১৫ দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। বাকি জমি থেকে স্টুডিও সরানোর জন্য তিন মাস সময় চায় প্রযোজক সংস্থাটি।
ভেঙ্কটেশের ওই আর্জি অবশ্য পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৮ তারিখ ভেঙ্কটেশের আইনজীবীকে চিঠি দিয়ে তাঁরা বলেন, বন্দরকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এলএমজে-র সঙ্গে চুক্তি করেছিল প্রযোজক সংস্থাটি। তার চেয়েও বড় কথা হল, এই ধরনের চুক্তি করার কোনও এক্তিয়ারই তাদের নেই। ফলে বন্দরের চোখে ভেঙ্কটেশ জবরদখলকারী। অবিলম্বে ওই জমি তাদের ছেড়ে দিতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে একই আর্জি নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে ভেঙ্কটেশ। আদালতে দায়ের করা পিটিশনে এলএমজে-র সঙ্গে বন্দরের মামলায় ভেঙ্কটেশকে পার্টি করার আবেদনও জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী সঞ্জয় বসু। একই সঙ্গে প্রযোজক সংস্থার অভিযোগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং এলএমজে-র ১৮ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখে তাদের মনে কিছু সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। এলএমজে তার চিঠিতে বলেছে, বন্দরের জমির দখল নিতে যাওয়াটা ছিল নেহাতই আনুষ্ঠানিকতা। অন্য দিকে বন্দরের দাবি, তারা প্রকৃত অর্থেই জমির দখল নিতে গিয়েছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ কেন এলএমজে-কে বাদ দিয়ে শুধু তাদেরই জবরদখলের জন্য দায়ী করছে, সেই প্রশ্নও তুলেছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
সরকারি ভাবে এ নিয়ে মুখ না-খুললেও বন্দর কর্তাদের বক্তব্য, বন্দরের জমি লিজ দেওয়া হয়েছিল অ্যাভেরি ইন্ডিয়া নামে একটি সংস্থাকে। লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে জমির দখল নিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে বেশ কয়েকটি সংস্থা। এ নিয়ে মামলা করা হলে এলএমজে কনস্ট্রাকশন আদালতে হাজির হয়ে বলে, যে হেতু তারা এত দিন জমির দেখভাল করত, তাই তাদের সঙ্গেই নতুন করে লিজ চুক্তি করা হোক। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আইনগত দিক থেকে এলএমজে-র সঙ্গে বন্দরের কোনও সম্পর্ক নেই। আর জমি অধিকার করে রয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। তাই যাবতীয় অভিযোগ ওই দুই সংস্থার বিরুদ্ধেই করা হচ্ছে।
অন্য দিকে, এলএমজে-র পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। ১৩ তারিখের ঘটনার পরে তারাতলা থানায় সংস্থার তরফে অভিযোগ করা গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিষয়টি বিচারাধীন। ২৪ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানি হবে। আদালতেই যা বলার বলব।’’
আইন-আদালতে কী হবে পরের কথা, জবরদখল হওয়া জমি ফিরে পেতে এ বার রাজ্য সরকারের উপরে চাপ বাড়াতে চান বন্দর কর্তৃপক্ষ। সূত্রের খবর, জাহাজ মন্ত্রকের সচিব রাজীব কুমার চিঠি লিখবেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে। তাতে কাজ না হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাহায্য চাওয়া হবে। দরকার হলে জাহাজমন্ত্রী নিজে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে চান। রাজ্যকে বোঝানো হবে, এই সব ক্ষেত্রে আইন মোতাবেকই চলা উচিত। নইলে শিল্পমহলে ভুল বার্তা যাবে।
জাহাজ মন্ত্রকের কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, ভেঙ্কটেশ-কর্তা শ্রীকান্ত মোহতা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলেই তাঁর জবরদখল করা জমি উদ্ধারে পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। জমি দখলমুক্ত করার জন্য সাহায্য চেয়ে দফায় দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছিল কলকাতা পুলিশকে। তারাতলা থানাকে জানানো হয়েছিল ১৩ তারিখেও। কিন্তু পুলিশ নিষ্ক্রিয়ই ছিল। ভেঙ্কটেশের মস্তানরা জমি ফের দখল করে নেওয়ার পরেও তাদের সাড়া মেলেনি। ভেঙ্কটেশের অবশ্য দাবি, বন্দরের জমি দখলের বিষয়ে বিন্দুবিসর্গও তাদের জানা ছিল না। বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া চিঠিতে প্রযোজক সংস্থার আইনজীবী দাবি করেছিলেন, এলএমজে-র নিরাপত্তারক্ষীরাই সে দিন যা করার করেছিল। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, জমি পুনর্দখল এবং আনন্দবাজারের সাংবাদিক-চিত্র সাংবাদিককে নিগ্রহের কাজে ভেঙ্কটেশের লোকেদের পাশাপাশি হাত মিলিয়েছিল তৃণমূলের কর্মীরা। ভেঙ্কটেশকে দেওয়া চিঠিতে এলএমজে অভিযোগ করেছে, তাদের কিছু না-জানিয়েই প্রযোজক সংস্থার লোকজন পেশি আস্ফালন করে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাজে বাধা দিয়েছে।
ঘটনার দায় যারই হোক, পুলিশ কিন্তু সে দিন দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টাই করেনি। যার জেরে বন্দর জমির দখল নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই তা ফের ভেঙ্কটেশের হাতে চলে যায়। কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আসা পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার রিপোর্ট দেখে জাহাজমন্ত্রী ক্ষুব্ধ বলেই মন্ত্রক সূত্রের খবর। আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে নিতিনের কথোপকথনেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। জাহাজমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, তৃণমূল অসন্তুষ্ট হবে বলে তাদের ঘনিষ্ঠ সংস্থার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা থেকে কি কেন্দ্র পিছিয়ে আসতে পারে? নিতিনের জবাব, ‘‘কিসকা হ্যায়, কঁহা হ্যায়, সব পতা হ্যায়। উসকো উখাড়কর ফেকেঙ্গে। আপ ইতনা লিখ লিজিয়ে। ও ইল্লিগাল হ্যায়। ছোড়েঙ্গে নহি।’’