বন দফতরের হয়ে বাঘ তাড়াতে গিয়ে বাঘের কামড়েই ডান চোখ নষ্ট হয় গণেশ শ্যামলের। মেলেনি সরকারি সাহায্য। — নিজস্ব চিত্র।
শীতের সকালে ঠাকুরান নদীর ঘাটে কলকাতার লঞ্চ ভিড়েছে। এনেছে কম্বল আর খাবারদাবার। লাইন দিচ্ছেন গ্রামের মানুষ। গ্রামে ‘শহরের দান’ আসার কথা আগাম চাউর হয়ে যাওয়ায় নদীর ধারে ভিড় জমেছে সকাল থেকেই। পরিবার নিয়ে সেই লাইনের দিকে ছুটলেন স্থানীয় বাসিন্দা গণেশ শ্যামল।
গত বছর মৈপীঠের নগেনাবাদে স্থানীয় ২০ নম্বর জঙ্গল থেকে বাঘ ঢুকেছিল এমনই শীতের সময়ে। বন দফতর চেষ্টা করছিল, গ্রামবাসীদের রোষ থেকে সেই বাঘকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে আবার যাতে জঙ্গলে ফেরত পাঠানো যায়। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বন দফতরের হয়ে বাঘকে জঙ্গলের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছিলেন গণেশ শ্যামলের মতো অনেকে। আচমকাই বাঘের মুখোমুখি পড়ে যান গণেশ। পাছে বাঘ ঘাড়ে কামড় দেয়, তাই ঝট করে মাথাটা উঁচু করে দিয়েছিলেন তিনি। বাঘের কামড় পড়ে গণেশের ডান চোখে।
সেই ডান চোখে আর দেখতে পান না গণেশ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরবর্তী কালে তাঁকে কিছু আর্থিক সাহায্য করেছে ঠিকই। কিন্তু গণেশ জানান, বন দফতরের তরফে কোনও ক্ষতিপূরণ তাঁকে দেওয়া হয়নি।
বন দফতরের কাজ করতে গিয়েই তো বাঘের কামড় খেয়ে এলেন গণেশ। অথচ সরকার তাঁকে এখনও পর্যন্ত কোনও ক্ষতিপূরণ দিল না কেন? প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। তিন দফায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ঘুরে এসেছেন গণেশ। কিন্তু চোখের অস্ত্রোপচার আজও হয়নি তাঁর। গণেশের কথায়, ‘‘স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আর্থিক সাহায্যে চোখের চিকিৎসা করাচ্ছি। সেই টাকাতে সংসারও চলছে। আমি কাজকর্ম করতে পারি না। গ্রামে দান এলে লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। সময় মতো অস্ত্রোপচার হলে চোখটা হয়তো ঠিক হয়ে যেত। এখন ডান চোখে কিছু দেখতে পাই না।’’
মৈপীঠে দেবীপুর গ্রামে বাড়ির বাইরে চেয়ার পেতে বসে গণেশ দেখাচ্ছিলেন হাতে আর আঙুলে সেলাইয়ের দাগ। বাঘ নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত দশা হয়েছিল সেই হাতের। গণেশ বলে চলেন, ‘‘এখানকার মানুষ খুব গরিব। চাষবাসের কাজ সারা বছর হয় না। নদীতে মাছ, মীন, কাঁকড়া ধরতে না-গেলে উনুনে হাঁড়ি চড়বে না। বন দফতর বলে, ব্যাঘ্র প্রকল্পের মধ্যে থাকা জঙ্গলে মাছ ধরা বেআইনি। তাই ওই সব জায়গায় বাঘে ধরলে ক্ষতিপূরণ নেই। কিন্তু মাছ-কাঁকড়া তো গভীর জঙ্গলের লাগোয়া খাঁড়িতেই মেলে। নদী আর জঙ্গলের সঙ্গে আমাদের কয়েক পুরুষের সম্পর্ক।’’
বন দফতরের স্থানীয় কর্মীরা যদিও জানাচ্ছেন, জঙ্গলের ভিতরে কোথায় মাছ-কাঁকড়া ধরা যেতে পারে, তার জন্য বিশেষ জায়গা (যাকে বলে ‘বাফার জ়োন’) নির্ধারিত আছে। স্থানীয় এক বন আধিকারিকের কথায়, ‘‘বিস্তীর্ণ এলাকায় তারের বেড়া দেওয়া আছে, যাতে বাঘ লোকালয়ে চলে না আসে। কিন্তু অনেক সময়ে গ্রামবাসীরা সেই বেড়া কেটেই জঙ্গলে ঢুকে পড়েন। আর ওই কাটা অংশের বেড়া ভেঙে বাঘ লোকালয়ে চলে আসে। গ্রামবাসীদের বার বার বোঝানো সত্ত্বেও তাঁরা বন দফতরের নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব দেন না। সেই কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।’’
এর পাল্টা এপিডিআরের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সহ-সম্পাদক মিঠুন মণ্ডলের দাবি, ‘‘বাফার জ়োন কোথায়, তা নিয়ে ঠিকঠাক প্রচারই নেই সরকারের তরফে। ফলে বাফার জ়োনের সীমানা জানেন না সিংহভাগ মৎস্যজীবীই। আর যতটুকু বাফার জ়োন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় রয়েছেন মৎস্যজীবীরা।’’ মিঠুন আরও বললেন, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, বাঘের হানায় মৃত্যু হলেই সরকারকে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাফার কিংবা কোর এলাকা দেখা চলবে না। জীবিত থাকলে, শরীরের চল্লিশ শতাংশজখম হলে সর্বোচ্চ দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যকে বন দফতরে চাকরিও দিতে হবে।
গ্রামের মানুষের অভিযোগ, বাঘের কামড়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেই বন দফতরের তরফে প্রথম ‘অজুহাত’ খাড়া করা হয় যে, কেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জঙ্গলে গিয়েছিলেন? এপিডিআর জানাচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছিল মৈপীঠের পূর্ব গুড়গুড়িয়ার কানাই ঘোষের মৃত্যুর পরেও। ২০১৮ সালে বাঘের আক্রমণে মারা যান কানাই। জঙ্গলের বিপদসঙ্কুল ‘নিষিদ্ধ এলাকাতেই’ ঢুকেছিলেন তিনি। গত এক বছর ধরে বন দফতর তথা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা লড়ে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে কানাইয়ের পরিবার ক্ষতিপূরণের পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছে। ছোট ছেলে আকাশ চাকরি পেয়েছেন বন দফতরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে দু’জন এবং গত এক বছরে মোট ন’জন এই সব এলাকায় বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছেন। এপিডিআরের অভিযোগ, দুর্ঘটনার পরে তিন, চার এমনকি দশ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ জোটেনি কোনও কোনও মৎস্যজীবী পরিবারের। মিঠুনের কথায়, ‘‘যে ক’টি ক্ষতিপূরণ হয়েছে, তার সিংহভাগই মামলা করার পরে পাওয়া গিয়েছে।’’ তাঁর প্রশ্ন, হাতির হানার ক্ষেত্রে যখন দ্রুত ক্ষতিপূরণ মেলে, তখন বাঘের হানার ক্ষতিপূরণ পেতে প্রাণান্তকর অবস্থা হবে কেন?
এ নিয়ে কথা বলতে ফোন ও মেসেজ করা হল বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদাকে। উত্তর এল না।
কৈখালি আশ্রমের বাসিন্দা হরিপদ দাস দেখালেন, ক্ষতিপূরণ চেয়ে তাঁর পাঠানো আর্জি বন দফতর থেকে ফেরত এসেছে। ক্ষীণ হেসে হরিপদ বলেন, ‘‘বাঘের কামড় খেয়ে ঘরে পড়ে আছি। ক্ষতিপূরণ তো দূর, কোনও তরফেই কোনও সাহায্য পাইনি। এক বার গ্রামের এক পঞ্চায়েত সদস্য এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন। তবে এ বার হয়তো আসবেন কেউ। ভোট আসছে তো!’’
(চলবে)
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে