ক্ষতিপূরণে দেরি, দিশাহারা অ্যাসিড-দগ্ধ ছাত্রী

দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যেই তাদের হাতে ক্ষতিপূরণের এক লক্ষ টাকা পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই টাকার নামগন্ধ নেই। ফলে প্রায় এক মাস ধরে অ্যাসিড-দগ্ধ তরুণীর যথাযথ চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক খরচ জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের বেরা পরিবার।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩০
Share:

দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যেই তাদের হাতে ক্ষতিপূরণের এক লক্ষ টাকা পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই টাকার নামগন্ধ নেই। ফলে প্রায় এক মাস ধরে অ্যাসিড-দগ্ধ তরুণীর যথাযথ চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক খরচ জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের বেরা পরিবার।

Advertisement

গত ২৮ মে ওই পরিবারের মেধাবী তরুণীকে লক্ষ করে অ্যাসিড ছোড়ে এক দুষ্কৃতী। উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পরে মেয়েটি কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন। তারই মধ্যে রাতে বাড়িতে ঢুকে ছোড়া হয় অ্যাসিড। তাঁর মুখের ডান দিক এবং শরীরে উপরের অংশ পুড়ে যায়। একই খাটে শুয়ে থাকা তাঁর ভাই এবং মা-ও জখম হন অ্যাসিডে। সেই ঘটনায় মেয়েটির সঙ্গে প্রণয়-সম্পর্ক গড়তে চাওয়া এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে অ্যাসিডের জ্বালা প্রশমিত হয়নি। আঘাত সামলে পড়াশোনা চালাবেন কী ভাবে, সেই চিন্তায় দিশাহারা দশা মেয়েটির। তাঁর দগ্ধ-ক্ষত নিরাময়ের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারটিও বিপাকে।

অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, অ্যাসিড-হামলার ক্ষেত্রে আক্রান্তকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দু’দফায় তিন লক্ষ টাকা দিতে হবে ঘটনার আড়াই মাসের মধ্যে। কিন্তু এ রাজ্যে এখনও সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি। তাই মাস গড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তির টাকা হাতে পাননি ওই তরুণী। সরকারি খরচে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে ঠিকই। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মেয়েটির ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাঁ চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা। ডান কানের অর্ধেকটা অ্যাসিডে পুড়ে গিয়েছে। চেহারাতেও দেখা দিয়েছে বিকৃতি। বিশেষ করে মুখের ডান দিক, শরীরের ঊর্ধ্বাংশ এবং ডান হাতে।

Advertisement

হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, মেয়েটির শরীরের বিকৃত অংশগুলিতে প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে। কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীন পোড়া ক্ষত যাতে আরও সংক্রমিত হয়ে না-পড়ে, তার জন্য চাই নির্দিষ্ট ওষুধ আর ভাল খাবারদাবার। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলোর সংস্থান করতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছে পরিবারটি। তরুণীর বাবা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালান মা। কিন্তু পরিবারের সেই একমাত্র উপার্জনকারিণীও এখন কলকাতায়, মেয়ের পাশে। ফলে রোজগার বন্ধ।

তরুণীর দিদি বললেন, ‘‘ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বিভিন্ন দফতরে ঘুরে ঘুরে সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু টাকা মেলেনি। সর্বত্রই আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কবে ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে আসবে, নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি কেউই।’’

আইন যে-ক্ষতিপূরণ দিতে বলছে, তা পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

অ্যাসিড-আক্রান্তদের নিয়ে কর্মরত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যুগ্ম অধিকর্তা অনিতা ডি’সুজা জানাচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রতিটি রাজ্যেরই মুখ্যসচিবকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোথায়, কবে, কার উপরে অ্যাসিড-হামলা হচ্ছে, তাঁর চিকিৎসা কী ভাবে হচ্ছে— ঠিক সময়ে তা জানা যাচ্ছে না। আক্রান্তের মামলার কাগজপত্র সরকারের কাছে কে জমা দেবে, অনেক ক্ষেত্রে তা-ও অনিশ্চিত। এই অবস্থায় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকেই খুঁজে খুঁজে মামলার কাগজপত্র বার করে সরকারের কাছে বা আদালতে পাঠাতে হচ্ছে। তাই ক্ষতিপূরণ পেতে বছর গড়িয়ে যাচ্ছে।

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সূত্রের খবর: বেরা পরিবারের মেয়েটির উপরে হামলা তো হয়েছে মাত্র মাসখানেক আগে। ২০০১ সাল থেকে ১৪ বছর ধরে এ রাজ্যের অন্তত ১৭ জন অ্যাসিড-আক্রান্ত মহিলা-পুরুষ অপেক্ষা করে আছেন, কবে সরকারি ক্ষতিপূরণের তিন লক্ষ টাকা পাবেন। অ্যাসিডের ছোবল শরীরে যে-দাগ রেখে গিয়েছে, চিকিৎসায় তা ঢাকা দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন অনেকে। কিন্তু সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে আসেনি।

যেমন মুর্শিদাবাদের এক গৃহবধূ। কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় ২০০১ সালে স্বামী তাঁর উপরে অ্যাসিড ছোড়েন বলে অভিযোগ। ওই গৃহবধূর মুখ, গলা-সহ শরীরের উপরের অংশ পুড়ে যায়। পুলিশ তাঁর স্বামী-শাশুড়িকে গ্রেফতারও করে। কিন্তু ১৪ বছরেও ক্ষতিপূরণ মেলেনি। নজরুল ইসলাম নামে মুর্শিদাবাদেরই অন্য এক বাসিন্দা জমি কেনার জন্য গয়না বন্ধক দিয়েছিলেন এলাকার একটি সোনার দোকানে। পরে সেই গয়না ছাড়াতে গেলে গয়না ব্যবসায়ী তা ফেরত দিতে চাননি। বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন নজরুল। তখনই সেই ব্যবসায়ী দোকান থেকে গয়না গলানোর অ্যাসিড এনে তাঁর মুখে ছুড়ে দেন বলে অভিযোগ। ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি নজরুলও।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৭ জন অ্যাসিড-আক্রান্ত ক্ষতিপূরণের দাবিদার। তাঁদের মধ্যে দু’জনকে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু তাঁরাও টাকা পাননি অন্য ১৫ জনের মতো।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষতিপূরণের আশায় দিন গুনছেন তাঁরা। এই অবস্থায় দাসপুরের বেরা-বাড়ির মেয়েটি কবে সরকারি টাকা পাবেন, জানেন না স্বেচ্ছাসেবীরাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন