প্রেসিডেন্সির ঘেরাও যেন চটকলে আন্দোলন: সুব্রত

প্রাক্তন ছাত্রনেতা তিনি। পূর্বতন শ্রমিক-নেতাও। কিন্তু ছাত্র-আন্দোলনের নামে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইদানীং যা চলছে, রবিবার সেটাকে তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এবং বিঁধলেন শ্রমিক-আন্দোলনের কথা টেনেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৬ ০৪:১০
Share:

ফাইল ছবি

প্রাক্তন ছাত্রনেতা তিনি। পূর্বতন শ্রমিক-নেতাও। কিন্তু ছাত্র-আন্দোলনের নামে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইদানীং যা চলছে, রবিবার সেটাকে তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এবং বিঁধলেন শ্রমিক-আন্দোলনের কথা টেনেই। চটকলের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রেসিডেন্সির ঘেরাওয়ের তুলনা করেছেন তিনি। এ দিন আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়াও।

Advertisement

শিক্ষাঙ্গনে ঘেরাওয়ের মতো আন্দোলন ঠিক নয় বলে শনিবারেই মন্তব্য করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। উচ্চশিক্ষায় উৎকর্ষ নিয়ে একটি আলোচনাচক্রে তিনি বলেন, ‘‘দাবি আদায়ের জন্য কাউকে লাগাতার ঘেরাও করা ঠিক নয়।’’ সেই সঙ্গে শৃঙ্খলা রক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের উদ্দেশে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, কোনও ভাবেই যেন পড়ুয়াদের অবান্তর দাবির কাছে নতি স্বীকার করা না-হয়। মন্ত্রিসভায় পার্থবাবুর সহকর্মী সুব্রতবাবুও এ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে ঘেরাও করার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের সমালোচনা করেন চড়া সুরে। কলামন্দিরে একটি বেসরকারি স্কুলের অনুষ্ঠানের পরে তিনি বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের আন্দোলন চটকল আন্দোলনের নামান্তর। এবং শুধু প্রেসিডেন্সি নয়, কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আন্দোলনের নামে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা মানা যায় না।’’

পঞ্চায়েতমন্ত্রীর সঙ্গে এ দিন ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিলেন প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধাদেবী। তিনি যথাযথ ভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন বলে মঞ্চে বসেই তাঁর প্রশংসা করেন সুব্রতবাবু। তবে সভায় প্রেসিডেন্সির নাম উল্লেখ করেননি তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনুরাধাদেবীও মঞ্চে কিছু বলেননি। কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষে কোনও রাখঢাক না-করে তিনিও প্রেসিডেন্সির এক শ্রেণির পড়ুয়ার আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। উপাচার্য বলেন, ‘‘মুষ্টিমেয় কিছু পড়ুয়ার জন্য প্রেসিডেন্সির মতো নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কালিমালিপ্ত হচ্ছে। কাউকে ব্ল্যাকমেল করে বা ঘেরাও করে দাবি আদায় করা যায় না। যারা আন্দোলন করছে, তারা পড়াশোনা করে না। যারা পড়াশোনা করে, তারা অযৌক্তিক দাবি করে না।’’

Advertisement

শিক্ষা-প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্সির কর্ণধার হিসেবে অনুরাধাদেবীর এই বয়ান স্বাভাবিক বলেই শিক্ষা শিবিরের অভিমত। তবে প্রশ্ন উঠছে, এক কালের দুর্ধর্ষ ছাত্রনেতা হিসেবে যাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ, সেই সুব্রতবাবু চটকলের আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনকে এক স্তরে ফেলছেন কী ভাবে? কী করে বলছেন, প্রেসিডেন্সির ঘেরাও যেন চটকলে আন্দোলন? ঘেরাওকারী পড়ুয়াদের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি কি চটকলের শ্রমিক আন্দোলনকে খাটো করতে চাইছেন?

সুব্রতবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘না। আমি মোটেই চটকলের আন্দোলনকে খাটো করছি না। চটকল আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে এক নয়, সেটাই বোঝাতে চাইছি। বলতে চাইছি, চটকলে যে-ভাবে আন্দোলন হয়, হুটহাট ধর্না-ঘেরাও-কর্মবিরতি হয়, শিক্ষালয়ে তেমনটা চলতে পারে না।’’ তাঁর মতে, দাবি আদায়ের আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের পড়ুয়ারা ঘেরাওয়ের নামে যে-রাজনীতি করছে, তা সীমা লঙ্ঘন করছে। আন্দোলনেও একটা শৃঙ্খলা থাকা দরকার। ‘‘ছাত্র-রাজনীতি আমরাও করেছি। তা বলে এ-রকম বিশৃঙ্খল ছিলাম না,’’ বললেন মন্ত্রী।

শুক্রবার রাত ৮টা থেকে প্রেসিডেন্সির রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনার-সহ কিছু আধিকারিককে ১৯ ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখেন এক দল পড়ুয়া। শনিবার প্রেসিডেন্সি-কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবিদাওয়া ভেবে দেখার আশ্বাস দেওয়ায় ঘেরাও তুলে নেওয়া হয়। তবে পড়ুয়ারা হুমকি দিয়েছেন, আজ, সোমবারের মধ্যে সব দাবি না-মানলে ফের আন্দোলন শুরু হবে।

‘‘আন্দোলনকারীদের দাবি, ফেল করা পরীক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে দিতে হবে। এটা কি কোনও সভ্য সমাজের দাবি হতে পারে,’’ প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষুব্ধ অনুরাধাদেবী। তাঁর বক্তব্য, কয়েক জন আন্দোলনকারীর জন্য বহু মেধাবী ছাত্রছাত্রী প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ভয় পাচ্ছে।

উপাচার্য ও পঞ্চায়েতমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন আন্দোলনকারীরা। ‘‘উপাচার্যের হয়তো মনে হয়েছে, ছাত্র-রাজনীতি খারাপ। আসলে আন্দোলনকে ভয় পেয়েছেন কর্তৃপক্ষ। প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষার মান কেন দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে, একের পর এক শিক্ষক-শিক্ষিকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন, উপাচার্য কি তার উত্তর দিতে পারবেন,’’ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্সিতে এসএফআইয়ের ইউনিট সম্পাদক অর্কপ্রভ মুখোপাধ্যায়। আর সুব্রতবাবুর মন্তব্য সম্পর্কে ওই বাম ছাত্রনেতা প্রশ্ন তুলেছেন, সুব্রতবাবু কি চটকলে আন্দোলনকে এতটাই খারাপ চোখে দেখেন? অর্কপ্রভর ঘোষণা, ‘‘যে-কোনও ধরনের অপশাসনের বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই চলবে।’’

প্রাক্তন ছাত্রনেতা তো বটেই, সেই সঙ্গে সুব্রতবাবু যে পূর্বতন শ্রমিক-নেতাও, সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন অর্কপ্রভর দল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘সুব্রতবাবু নিজে ছাত্র আন্দোলন করে উঠে এসেছেন। শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি-রও নেতা ছিলেন দীর্ঘদিন। এমন মন্তব্য করে তিনি ছাত্র বা শ্রমিকদের চেয়েও নিজেকেই আসলে বেশি খাটো করলেন!’’

একদা সুব্রতবাবুর নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলনে নেমেছিলেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। তাঁর দাবি, প্রেসিডেন্সির এখনকার পড়ুয়াদের মতো সে-কালে ছাত্র পরিষদ কিন্তু ঘেরাও আন্দোলন করেনি। ঘেরাও-রাজনীতি প্রথমে এসইউসি-র সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরে আরএসপি-র যতীন চক্রবর্তীর অবদান। ‘‘সুব্রতবাবু ছিলেন আগুনখোর ছাত্রনেতা। তাঁর নেতৃত্বে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছি। চটকল শ্রমিকদের সঙ্গে কেন তিনি তুলনা করতে গেলেন, জানি না! তবে এমন মন্তব্য না-করলেই ভাল ছিল,’’ বলছেন মানসবাবু।

শিক্ষা শিবিরের একাংশের বক্তব্য, সুব্রতবাবুর তুলনাত্মক মন্তব্যে বিতর্ক চলতেই পারে। তবে প্রেসিডেন্সির বিশৃঙ্খলা নিয়ে তিনি যে-ভাবে সরব হলেন, তা সময়োপযোগী। তাঁকে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, শিক্ষায় বিশৃঙ্খলা রুখতে কী করছে তাঁর সরকার?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন