‘অন্যায় আইন থেকে তোরা মুক্ত হলি’

আইনজীবীদের তৈরি হলফনামায় চোখ বুলিয়ে ছেলে অনীশকে একটাই কথা বলেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরী। ‘‘ছেলে হিসেবে তোর জন্য যে আমরা গর্বিত, সেই কথাটা হলফনামায় নেই কেন?’’ 

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:০৬
Share:

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনীশ। ফাইল চিত্র

আইনজীবীদের তৈরি হলফনামায় চোখ বুলিয়ে ছেলে অনীশকে একটাই কথা বলেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরী। ‘‘ছেলে হিসেবে তোর জন্য যে আমরা গর্বিত, সেই কথাটা হলফনামায় নেই কেন?’’

Advertisement

৩৭৭ ধারা নিয়ে মামলায় ২০০৯ সালে ১৯ জন সমকামী ছেলের মা-বাবার সই-করা হলফনামা পেশ করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। বিজয়লক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী প্রমথনাথও সেই দলের। দু’জনেই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। চন্দননগরের ‘সংস্কৃত দিদিমণি’র কথায় বাড়তি বাক্য যোগ হয়েছিল হলফনামায়— ‘আমাদের ছেলে এত দিন মানুষের ভালর জন্যই নানা কাজ করে এসেছে। তাই মা-বাবা হিসেবে আমরা গর্বিত।’

বৃহস্পতিবার সকালে টিভি-র সামনে বসে এক ধরনের যুদ্ধজয়ের অনুভবই হচ্ছিল বিজয়লক্ষ্মীর। আফসোস, অনীশের বাবা ৮৮ বছরের প্রমথনাথ বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী। এই দিনটাকে পুরো বুঝে ওঠার ক্ষমতা নেই তাঁর। অধুনা তিরাশির বৃদ্ধা বিজয়লক্ষ্মী ছেলেকে বললেন, ‘‘অন্যায় আইন থেকে তোরা মুক্ত হলি! প্রথমে সবটা ভাল বুঝিনি। কিন্তু তুই অন্যায় করছিস, এমন কখনও ভাবিনি! ’’

Advertisement

বছর ১৮ আগে সত্তর ছুঁই ছুঁই দম্পতির জন্য ধাক্কাটা সোজা ছিল না। ছোট থেকে একমাত্র ছেলেকে গীতা-চন্ডীপাঠ করিয়েছেন মা। ৩১ বছরের অনীশের যৌনঝোঁকের দিকটা শুনে ‘লোকলজ্জা’ এবং নাতিনাতনির মুখ দেখতে না-পারার কষ্টও ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাঁকে। ৩৭৭-এর ভয়ে ছেলের নিরাপত্তার জন্য চিন্তায় পড়েন বাবাও।

আরও পড়ুন: সমকাম অপরাধ নয়, ঐতিহাসিক রায় শীর্ষ আদালতের

আরও পড়ুন: মা বললেন, মুখ বন্ধ হবে কাকু-কাকিমার?

মা একমাত্র ছেলেকে বলে ফেলেন, ‘এক তরকারি, তা-ও নুনে পোড়া’! সে-ই মা এবং বাবা ক্রমে অনীশের গত ন’বছরের জীবনসঙ্গীরও পরম সুহৃদ হয়ে উঠেছেন। অনীশ পারিবারিক ব্যবসা ও শিক্ষকতায় ব্যস্ত। তাঁর সঙ্গী একটি কর্পোরেট সংস্থার কর্মী। তাঁকে ‘জাম্বো’ বলে ডাকেন প্রমথবাবু। নিজের আঁকা শেষ ছবিটিও তাঁকেই উপহার দিয়েছেন।

তবে এটা এক দিনে ঘটেনি। অনীশ প্রথমে মাকে সমকামী তথা যৌন সংখ্যালঘুদের আন্দোলনের কথা বোঝাতে থাকেন। মা জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুমিও কি ওদেরই মতো?’ খানিকটা সময় নিয়ে অনীশ তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বলেন! বিষয়টা হজম করতে সময় লেগেছিল। সমকামিতা যে অসুস্থতা নয়, তা বোঝাতে নানা প্রামাণ্য প্রতিবেদন, আমেরিকার মনোরোগ চিকিৎসকদের বক্তব্য মাকে পড়াতে থাকেন অনীশ। ছেলের অন্য সমকামী বন্ধুদের উপরে নির্যাতনের ঘটনাও স্পর্শ করে অনীশের মা-বাবাকে।

ফলে, ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামায় সই নিয়ে দু’বার ভাবেননি বিজয়লক্ষ্মী। বাবা-ছেলের মধ্যে সংযোগের কাজটাও মা-ই করতেন। তবে হলফনামায় সই করার সময়ে প্রমথনাথও বলেছিলেন, ‘‘ছেলের প্রবণতা নিয়ে বিচলিত নই।

এমন মানুষ যে আছেন, তা ভালই জানা আছে আমারও।’’ একই সময়ে অনীশের বন্ধু জয়দীপ জানার মা মমতাও সই করেছিলেন হলফনামায়। তিনিও এ দিন বলছেন, ‘‘ছেলেই তো আমার কাছে সমাজ! সব সময়ে ওর পাশে থাকব।’’ ছেলে যে নিজের মতো বাঁচছে এবং অন্যের অধিকার নিয়ে লড়ছে, তাতে গর্বিত বিজয়লক্ষ্মীও। তাঁর বিশ্বাস, ‘‘সমাজ এ ভাবেই এগোবে। সব মা-বাবাকে ছেলে বা মেয়ের পাশে থাকতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন