নন্দিতা চক্রবর্তী ও সুপর্ণা সাধু
এক জন রয়েছেন কলকাতা থেকে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার দূরে, কেশপুরে। বুধবারের ঘটনায় আতঙ্ক এখনও কাটেনি তাঁর। বলছেন, ‘‘কী করে ভরসা করি বলুন তো!’’
আর এক মহিলা খাস কলকাতায়। আতঙ্কিত তিনিও। একই সুর তাঁর গলায়, ‘‘এখানে কেউ নিরাপদ নয়।’’
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার কলকাতার সমাবেশ-মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সম্মান করতে বলেছেন। কিন্তু দুই কলেজের দুই শিক্ষিকাকে তা এখনও নিশ্চিন্ত করতে পারেনি ।
প্রথম জন কেশপুর কলেজের রসায়নের শিক্ষিকা, ওয়েবকুপা-র সদস্য সুপর্ণা সাধু। অসুস্থতার জন্য গত সোমবার ছুটি নেওয়ার ‘অপরাধে’ যাঁকে বুধবার টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মানস ঘোষ এবং তাঁর দলবলের
শাসানি ও হেনস্থার মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ।
অন্য জন নন্দিতা চক্রবর্তী। জয়পুরিয়া কলেজের শিক্ষিকা এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ওই কলেজে টিএমসিপি-র দুই গোষ্ঠীর বিবাদ ধারাবাহিক ভাবে চলছে। বুধবার টিএমসিপি-র এক ছাত্রকে কাচের বোতল ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সংগঠনেরই আর এক ছাত্রের বিরুদ্ধে। এই গোলমাল বাগে আনতে না পেরে আগামী সোমবার পর্যন্ত কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অতিষ্ঠ নন্দিতাদেবী। শুক্রবার কলেজের পরিচালন সমিতির কাছে নিজের পদত্যাগপত্রও পাঠিয়ে দিয়েছেন। বুধবারই আবার অশ্বিনীকুমার রায় নামে ওই
কলেজের এক শিক্ষককে রাস্তায় কয়েক জন যুবক মারধর করে এবং ফোনে তাঁকে পদত্যাগ করার জন্য হুমকি দেয় বলে অভিযোগ। হামলাকারীদের কাউকে চিনতে না পারলেও তারা কলেজের ছাত্র বলেই অশ্বিনীবাবুর ধারণা।
এ সবের পরে এ দিন নন্দিতাদেবী বলেন, ‘‘কেউ এখানে নিরাপদ নয়। এ ভাবে কলেজ চালানো সম্ভব নয়। তাই আমি সরে যেতে চাই। উচ্চশিক্ষা দফতরকেও বিষয়টি জানাব।’’ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সব শুনে এ দিন বলেন, ‘‘যদি টিএমসিপি-র মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হয়ে থাকে, দলের তরফে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কলেজের কাছেও রিপোর্ট চেয়েছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা না বলে কর্তৃপক্ষ কলেজ বন্ধ করে দিলেন কেন? অবিলম্বে কলেজ খুলতে হবে।’’ টিএমসিপি-র রাজ্য সভানেত্রী জয়া দত্তও বলেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনে ওই কলেজে সংগঠনের ইউনিট ভেঙে দেওয়া হবে।
ঘটনা হল, নবান্নে দ্বিতীয় ইনিংসে ফেরার পর থেকে দলকে কড়া অনুশাসনে বাঁধতে চাইছেন মমতা। কিন্তু তাঁর বার্তা যে সংগঠনের সর্বস্তরে এখনও পুরোপুরি কার্যকরী হচ্ছে না, কেশপুর ও জয়পুরিয়া কলেজের ঘটনাগুলোই তার উদাহরণ। এই আবহে এ দিনের ছাত্র-মঞ্চ থেকে মমতা তেমন কড়া বার্তা কিন্তু দেননি। গত কয়েক বছরে একুশে জুলাই শহিদ দিবস এবং টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বারবার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্য রুখতে তাঁকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিতে দেখা গিয়েছিল। এ দিন কিন্তু তিনি কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখার পরামর্শ দিয়েই ইতি টেনেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘আপনারাই রাজ্য গড়বেন। শিক্ষালয়গুলিকে সুন্দর করে তৈরি করবেন। আপনাদের প্রতি আমার প্রত্যাশা, ভরসা একটু বেশি।’’ শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যয়, ‘‘ছাত্র আন্দোলন থেকে চোর, ডাকাত সন্ত্রাসবাদী তৈরি হয় না!’’
সুপর্ণা, নন্দিতাদেবীরা তাই ভরসা পাচ্ছেন না।
কলেজমুখো হতেই ভয় পাচ্ছেন কেশপুর কলেজের শিক্ষিকা সুপর্ণাদেবী। মেদিনীপুরের বিধাননগরের বাড়িতে বেশির ভাগ সময় আট বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনি একাই থাকেন। স্বামী অভিজিৎ সামন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। টিভিতে এ দিন মমতার বার্তা শোনার পরে সুপর্ণাদেবী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো এমন কথা আগেও বলেছেন। কিন্তু ছাত্র নেতাদের আচরণ তো বদলায়নি। কী করে ভরসা করি বলুন তো!’’ গোটা ঘটনা ই-মেলে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তীকে জানিয়েছিলেন সুপর্ণাদেবী। ই-মেলে অভিযোগ পাঠান জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা এবং পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষকেও। উপাচার্য এ দিন বলেন, “কলেজের রিপোর্ট এসেছে। ওই শিক্ষিকার অভিযোগ গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে।”