অলচিকি হরফই চেনেন না শিক্ষক

পালাবদলের বছর ঘোরার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল—জঙ্গলমহল হাসছে। জমির পাট্টা, ২ টাকা কেজির চাল, আদিবাসী শিল্পীদের মাসিক ভাতা, কিংবা অলচিকি হরফে পঠন পাঠনের ঢালাও ব্যবস্থা—সেই হাসির স্বপক্ষে মণি-মুক্তার মতো আশ্বাস গুঁজে দিয়ে তৈরি হয়েছিল সরকারি প্রচার।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৫৫
Share:

একই ঘরে চলে খাওয়াদাওয়া ও পড়াশোনা। — নিজস্ব চিত্র

পালাবদলের বছর ঘোরার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল—জঙ্গলমহল হাসছে।

Advertisement

জমির পাট্টা, ২ টাকা কেজির চাল, আদিবাসী শিল্পীদের মাসিক ভাতা, কিংবা অলচিকি হরফে পঠন পাঠনের ঢালাও ব্যবস্থা—সেই হাসির স্বপক্ষে মণি-মুক্তার মতো আশ্বাস গুঁজে দিয়ে তৈরি হয়েছিল সরকারি প্রচার।

সরকারে আসার সাড়ে চার বছর পরেও প্রতিশ্রুত সেই ফুলের অধিকাংশই অবশ্য ফোটেনি! খোদ মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধন করা কল্যাণীর আপার প্রাইমারি আদিবাসী স্কুলটি তারই একটি জ্যান্ত নমুনা।

Advertisement

দূরান্তের জঙ্গলমহলের জেলা থেকে আদিবাসী পড়ুয়ারা আসবে, তাদের খাওয়া-থাকার সুব্যবস্থার পাশাপাশি সেই আপার প্রাইমারি স্কুল অচিরেই মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হবে— বছর দুয়েক আগে, হরিণঘাটার সরকারি মঞ্চ থেকে রিমোট দেগে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, কল্যাণীর সেই স্কুলের উদ্বোধন করে-ঢালাও আশ্বাস দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

তবে, ‘উন্নীত’ হওয়া দূর অস্ত্, সরকারের দরজায় বারবার ঘুরেও রাজ্যে সাঁওতালি মাধ্যমের এক মাত্র আপার প্রাইমারি স্কুলটির কার্যত চালুই করা যায়নি। খাতায় কলমে সে স্কুল অবশ্য দিব্যি চলছে। তবে স্কুলের আসল চেহারাটা হল, দূরের জেলা থেকে আসা ১২০ এবং স্থানীয় অন্তত জনা চল্লিশ ছেলে—দেড়শো পড়ুয়ার জন্য সে স্কুলে বরাদ্দ নাম মাত্র এক জন শিক্ষক এবং তিনি আলচিকি হরফের সঙ্গে সড়গড় নন।

ফলে পড়াশোনা শিকেয় তুলে একটি লম্বাটে ঘরে মেঝেতে ঢালাও বিছানা করে কোনওক্রমে দিন যাপন সেই পড়ুয়াদের। যাঁদের অনেকেই বলছেন, ‘‘এখন তো ঘরে ফিরতে চেয়েও পারছি না।’’

কী করে চলছে সে স্কুল? খাতায় কলমে ‘আপার প্রাইমারি’ সে স্কুলের অ্যাড-হক কমিটির সদস্য রাইমনি মুর্মু বলছেন, ‘‘দিশেহারা অবস্থা আমাদের। অলচিকি জানা শিক্ষক খুঁজে খুঁজে হয়রান। ছেলেগুলো পড়তেই পেল না!’’

তিনি জানাচ্ছেন, প্রশাসনের তরফ মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই আশ্বাস ছিল, একটি স্কুল বাড়ি হবে। থাকবে ছাত্রদের থাকার জন্য হস্টেলও। কিন্তু, সেই বাড়ি অনেকটা পরিত্যক্ত চেহারা নিয়ে দরজা-জানালাহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

পড়ুয়ারা জানাচ্ছে, একটা নির্মীয়মাণ ঘরই তাদের ঠাঁইনাড়া। নামেই ক্লাসরুম। সেখানে না আছে দরজা, না জানলা। খোলা হাওয়া আর রোদের ধাক্কা সামলে এক জন শিক্ষক কখন সময় দেবেন সেই অপেক্ষায় চুপ করে বসে থাকেন। ভাষা সমস্যায় তিনিও পড়ুয়াদের সঙ্গ কার্যত এড়িয়ে চলেন। ফলে, ‘স্কুল-স্কুল খেলা’ নিয়েই কোনওক্রমে টিঁকে রয়েছ স্কুলটি।

রাইমণিদেবী ধরিয়ে দিচ্ছেন, জেলা প্রশাসন থেকে সংশ্লিষ্ট দফতর কারও কাছেই সাহায্য মেলেনি। তাদের সটান জবাব ছিল— মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা হয়েছে ঠিকই তবে বরাদ্দের সরকারি কোনও নির্দেশই আসেনি। তিনি বলেন, ‘‘দু’বছর পেরিয়ে গেল এখন ছেলেগুলোকে কার্যত ভিক্ষে করে খাওয়াতে হয়!’’

স্কুলে প্রথম দেড় বছর কোনও শিক্ষকও মেলেনি। মাস কয়েক হল এক জন শিক্ষক পাওয়া গেলেও তিনি অবশ্য জানিয়ে দিচ্ছেন বাংলা জানেন, তবে অলচিকি হরফের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তাঁর। মুখ্যমন্ত্রীর সাধের প্রকল্পের এই হাল কেন?

জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ আধিকারিক সুরজিত পাল অবশ্য আশাবাদী। দু’বছর পরেও নির্বিকার গলায় তিনি বলছেন, ‘‘এক বছর হয়ে গেল, আমরা টাকা দিয়েছি। কাজ একটু ঢিমেতালে হচ্ছে ঠিকই, তবে হয়ে যাবে।’’

শিক্ষক কেন নেই? জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) মিতালি দত্ত বলেন, ‘‘সমস্যাটা আমরা জানি। কিন্তু, অলচিকি ভাষার শিক্ষক না পেলে কী করব বলুন?’’

কল্যাণীর আপার প্রাইমারি স্কুল তাই থেকেও নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement