তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব অপরাজিতা বিল আইনে কার্যকর না-হওয়া নিয়ে দায়ী করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। —ফাইল ছবি।
দুর্গাপুরের গণধর্ষণের ঘটনার পর ফের অপরাজিতা বিল প্রসঙ্গ সংবাদের শিরোনামে। শনিবার দুর্গাপুরের ঘটনার প্রতিবাদে বিরোধীদল বিজেপি রাজ্য সরকারের নারীসুরক্ষার ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জবাবে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব অপরাজিতা বিল আইনে কার্যকর না-হওয়া নিয়ে দায়ী করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে ‘গণধর্ষিতা’ হয়েছেন যে ডাক্তারি পড়ুয়া, তিনি আদতে ওড়িশার বাসিন্দা। সেই ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসতেই শনিবার সন্ধ্যায় ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝীর সচিবালয় সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানায়। পাল্টা আক্রমণে না-গেলেও, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাজিতা বিল নিয়ে কী মতামত জানিয়েছিলেন, তা আবার প্রকাশ্যে আনে বাংলার শাসকদল। সেই সূত্রেই আবার আলোচনা শুরু হয়েছে অপরাজিতা বিল নিয়ে।
গত বছর ৮ অগস্ট গভীর রাতে কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ করে খুন করা হয় এক চিকিৎসককে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ অগস্ট বাংলা জুড়ে ‘রাত দখল’ কর্মসূচি হয়। চিকিৎসকদের একাংশ আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে ধারাবাহিক বিক্ষোভ হতে থাকে রাজ্যের প্রায় সব প্রান্তে। গত বছর ২৮ অগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাদিবসের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঘোষণা করেন, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা রুখতে নতুন আইন আনবে রাজ্য সরকার। সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্য সরকারের সুপারিশে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অধিবেশনে সেপ্টেম্বর মাসে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ‘অপরাজিতা (নারী অধিকার সুরক্ষা) বিল ২০২৫’ পাশ হয়ে যায়। সেই বিলে সায় দিয়েছিল বিরোধীদল বিজেপি-ও। পরে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় রাজ্যপালের কাছে। সাধারণত রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে রাজ্যপাল স্বাক্ষর করলেই তা আইনে পরিণত হয়। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যপাল সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের কাছে সেই বিল সংক্রান্ত ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। আবার কোনও ক্ষেত্রে রাজ্যপাল যদি মনে করেন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজন, তখন তিনি সেই বিল পাঠাতে পারেন দিল্লিতে। আরজি কর হাসপাতালের ওই ঘটনা জাতীয় রাজনীতিকেও আন্দোলিত করেছিল। তাই রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বিলটি অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে। গত জুলাই মাসে সেই বিলটি রাষ্ট্রপতি ফেরত পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে। আপাতত বিধানসভা ঘুরে বিলটি পৌঁছেছে রাজ্য সরকারের সদর দফতরে।
রাষ্ট্রপতি ভবনের পাঠানো অপরাজিতা বিলটির বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে এবং তার সঙ্গে ব্যাখ্যা চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল আনন্দ বোসের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, জানা গিয়েছে তা-ও। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, মহিলাদের উপর অত্যাচার এবং ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় শাস্তি দিতে দেশে একটি আইন রয়েছে। সেই আইন থাকা সত্ত্বেও কেন আবার নতুন আইন তৈরির প্রয়োজন হল? প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির মুনিরকা এলাকায় চলন্ত বাসের ভিতর বছর তেইশের মেডিক্যালের ছাত্রীকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। সেই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় দেশ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই যুবতীকে প্রথমে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। ২৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ওই যুবতীর মৃত্যু হয়। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে রাজধানী দিল্লির রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সরব হয়েছিল আমজনতা। জনবিক্ষোভ সামাল দিতে সেই সময়ের মনমোহন সিংহ সরকার নতুন আইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই আইনটি তৈরির আগে বিচারপতি জেএস বর্মা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যারা মাত্র ২৯ দিনে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দেয়। সেই রিপোর্টে সুপারিশের ভিত্তিতেই সংসদের দুই কক্ষে ‘নির্ভয়া বিল’ (নির্যাতিতাকে সারা দেশে ‘নির্ভয়া’ নামেই পরিচিত করানো হয়েছিল) পাশ করিয়ে নতুন আইন তৈরি হয়েছিল।
সেই আইনের কথা উল্লেখ করেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাজভবনের কাছে নতুন আইন সম্পর্কে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। রাজভবন সূত্রে খবর, গত জুলাই মাসে নবান্নে পাঠানো বিলটি নিয়ে এখনও কোনও স্পষ্টও উত্তর আসেনি। তাই এ ক্ষেত্রে রাজ্যপালের কিছু করণীয় নেই বলেই জানা গিয়েছে। এমতাবস্থায় অপরাজিতা বিল এখন বিশবাঁও জলে বলেই মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। কারণ, যত দিন না রাজ্য সরকার রাষ্ট্রপতি ভবনের তোলা প্রশ্নে যুক্তিযুক্ত কোনও ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তত দিন এই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছে রাজভবনের একটি সূত্র। রাজ্য সরকার অপরাজিতা বিল প্রসঙ্গে কোনও ব্যাখ্যা দিলে তা রাজভবন মারফত পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতি ভবনে। সে ক্ষেত্রে নবান্নের পাঠানো জবাবে রাষ্ট্রপতি ভবন সন্তুষ্ট হলে, তবেই রাজ্যপালকে এ বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেবেন রাষ্ট্রপতি মুর্মু। এর পর অপরাজিতা বিল আইনে পরিণত হবে। আর যদি রাজ্য সরকারের পাঠানো উত্তরে রাষ্ট্রপতি ভবন সন্তুষ্ট না হয়, সে ক্ষেত্রে আবার বিলটি ফিরে আসবে পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে। এমন দড়ি টানাটানির মধ্যে অপরাজিতা বিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান প্রশাসনিক কর্তারাই। তাই শাসকদলের নেতারা অপরাজিতা বিল নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করলেও এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ রাজ্য প্রশাসনের কোনও কর্তা।