ছিলেন একা মা, এখন অনেকের মা

ছোট্ট বুরুনকে নিয়ে প্রাথমিক লড়াইটা ঘরের ভিতরেই শুরু হয়েছিল। শরীরের কোষে ৪৭টা ক্রোমোজোম (সাধারণত থাকে ৪৬টা) নিয়ে জন্মানো ‘ডাউন সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত বুরুনকে মেনে নিতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:১৫
Share:

খেলতে খেলতে শিখছে বুরুন। নিজস্ব চিত্র

ছোট্ট বুরুনকে নিয়ে প্রাথমিক লড়াইটা ঘরের ভিতরেই শুরু হয়েছিল। শরীরের কোষে ৪৭টা ক্রোমোজোম (সাধারণত থাকে ৪৬টা) নিয়ে জন্মানো ‘ডাউন সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত বুরুনকে মেনে নিতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। এক বছরের সন্তানকে বুকে করে ঘর ছেড়েছিলেন বছর সাতাশের অমৃতা মুখোপাধ্যায়। একা। দমদমের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে গিয়েছিলেন গোবরডাঙার বাড়িতে, মা-বাবার কাছে।

Advertisement

অমৃতা যখন লড়াইটা শুরু করলেন তাঁর বুরুনের জন্য, ক্রমেই দেখেছিলেন বুরুন একা নয়। বুরুনের মতো অসংখ্য খুদে লড়ছে। লড়ছে অসংখ্য প্রতিকূলতা নিয়ে আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের মতো বাঁচার জন্য। আর এই অসম লড়াইয়ে খামতি শুধু একটু ভরসা, সহানুভূতি, ভালবাসার।

পাঁচটা বছর পর প্রায় শ’খানেক বুরুন আশ্রয় পেয়েছে অমৃতার কাছে। গোবরডাঙার বাড়ির একটি ঘরেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা সেই আশ্রয়ের নাম ‘জাগরী’। অমৃতা বলছিলেন, ‘‘দিনভর বুরুনকে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে গিয়ে দেখতাম, কী ভীষণ অশিক্ষা রয়েছে এদের ঘিরে। শহরের দিকে আলোচনার সুযোগ যা-ও বা রয়েছে, আমাদের শহরতলি বা গ্রাম এলাকাগুলি একেবারেই অন্ধকারে।’’ তাই কাজের শুরু হিসেবে নিজের জন্মস্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন অমৃতা।

Advertisement

আরও পড়ুন: রাজ্যে ডাকঘর পেমেন্টস ব্যাঙ্ক বছরের মাঝামাঝি

প্রাথমিক ভাবে, নিজে হাতে লিফলেট লিখে শিয়ালদহ-বনগাঁ লাইনে একাই বিলি করতেন তিনি। যাত্রীদের কাছে গিয়ে গিয়ে অনুরোধ করতেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটছে না বা দৈনন্দিন কাজকর্মে কোনও দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে— এমন শিশুদের চিকিৎসার জন্য তিনি কাজ করছেন। ‘‘এমনও হয়েছে, ট্রেনের কামরাতেই কোনও বাচ্চাকে দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, তার সমস্যা রয়েছে। কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলতে গেলেই বিরক্ত হয়েছে তার অভিভাবক। বলেছে, ‘ও একদম ঠিক আছে। ও ‘পাগল’ নয়,’’ ম্লান হেসে বলছিলেন অমৃতা।

বস্তুত ‘ও পাগল নয়’— এটা প্রমাণ করতে মরিয়া অভিভাবকদের একটা বড় অংশ নিজেদের অজান্তেই নষ্ট করে ফেলেন বহু ‘স্পেশ্যাল’ প্রতিভা, সম্ভাবনা। আর এটাই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অমৃতার কাছে। সাধারণ মানুষকে বোঝানো, ওরা স্বাভাবিক, ওরা সক্ষম। প্রয়োজন শুধু একটু যত্নের। আর সেই যত্নের প্রয়োজন ওরা ‘পাগল’ বলে নয়, ‘স্পেশ্যাল’ বলে।

সম্প্রতি কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। যে অনুষ্ঠানে তাঁরা বারবার মনে করিয়ে দিলেন, এই প্রয়োজনটার কথাই। দাবি করলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত এক জন করে ‘স্পেশ্যাল এডুকেটর’ নিয়োগ করাটা বাহুল্য নয়, প্রাথমিক প্রয়োজন।

এই মুহূর্তে খুব কম বা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে অমৃতার সংস্থায় কাজ করছেন বেশ কয়েক জন স্পিচ থেরাপিস্ট, মিউজিক থেরাপিস্ট, ফিজিও থেরাপিস্ট, পুষ্টিবিদ, মনোবিদ। তাঁদের চিকিৎসায় এবং অমৃতার স্নেহে প্রতি দিন একটু একটু করে আলোয় ফিরছে খুদে দেবদূতের দল। সম্পাদক সূরজ চক্রবর্তী জানালেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এখানে বিনা পয়সায় যত্ন পায়। তবে যে-সব অভিভাবকের সামর্থ্য থাকে, তাঁদের থেকে ন্যূনতম অর্থ নেওয়া হয়। লক্ষ্য একটাই, আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই ডানা মেলুক বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের ইচ্ছেডানাগুলো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন