ব্যর্থতাতেও আশার আলো দেখছেন ওঁরা

তিনি জোরের সঙ্গে বলতে পারছেন, ‘‘শুধু ব্যর্থতা দেখব কেন? দেখতে হবে চেষ্টাটাকে। এসএসকেএমে তো সাফল্যের নজিরও আছে।। তা ছাড়া, এ বার যে ভাবে গ্রিন করিডর করে মৃতের দেহ থেকে তিনটি অঙ্গ তোলা হল, তাকে বাহবা দিতে হবে। এতটুকু অগ্রসর হতেও তো আমাদের অনেক বছর লেগেছে।’’

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০২:২৪
Share:

সুস্থতার পরে: মকসুদুলের সঙ্গে স্ত্রী রুবাইয়া সুলতানা। ছবি: নির্মল বসু

পরপর দু’টো মাস সম্পূর্ণ দু’টো আলাদা আবহ তৈরি করে দিয়েছে এসএসকেএমের ‘স্কুল অব ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার ডিজিজেস’-এ।

Advertisement

অক্টোবর মাসে ছিল জিতে যাওয়ার উচ্ছ্বাস। মৃত্যুমুখে চলে যাওয়া এক রোগীর লিভার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তাঁকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছিলেন চিকিৎসকেরা। বেঁচে থাকার অবলম্বন ফিরে পেয়েছিল তাঁর পরিবার।

ঠিক তার এক মাস পরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেও এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা হেরে গিয়েছেন। মৃতের দেহ থেকে নেওয়া লিভার অন্যের দেহে প্রতিস্থাপনের পরে গত শনিবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘যতটা শোকস্তব্ধ মৃতের পরিবার, ততটাই যন্ত্রণাক্লিষ্ট আমরা।’’

Advertisement

এমন একটা অবস্থায় তাঁদের ব্যর্থতা মুছে আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন সুস্থ হওয়া রোগী ও তাঁদের পরিবার। এমনকী, অতীতে এসএসকেএমে লিভার প্রতিস্থাপনের পরে মারা গিয়েছেন, এমন রোগীর নিকটাত্মীয়েরাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন চিকিৎসকদের। তাঁরা কুর্নিশ করছেন চিকিৎসক ও প্রশাসনের সার্বিক এবং সম্মিলিত চেষ্টাকে। তাঁদের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। দুরূহ লড়াইয়ে হার বা জিত— যে কোনও একটা হতে পারে। দেখতে হবে লড়াইটা কতটা খাঁটি ছিল। নিজেদের সবটুকু নিংড়ে দেওয়া হয়েছিল কি না। যদি সেটা হয়ে থাকে, তবে সেখানেই থাকবে ভবিষ্যতে আবার জিতে যাওয়ার বীজ।

সদ্য অতীতেই তো এসএসকেএমে জিতে যাওয়ার নজির রয়েছে। স্বরূপনগরের পাতুয়া পূর্বপাড়ার ২৫ বছরের মকসুদুল বিশ্বাস। ছোট এক পোলট্রি ফার্মের মালিক। মাস চারেক আগে বিয়ে করেছিলেন। তার পরে হঠাৎ মে মাসের এক রাতে রক্তবমি। পরীক্ষায় ধরা পড়ল ‘সিরোসিস অব লিভার’। লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া গতি নেই। বাবা জিয়াউল বিশ্বাসের কথায়, ‘‘হায়দরাবাদের এক চিকিৎসাকেন্দ্রে ছুটেছিলাম। তারা প্রতিস্থাপনের জন্য ৬০ লক্ষ টাকা চাইল। ছেলেকে নিয়ে ফিরে এসে এসএসকেএমে ভর্তি করালাম। তাই আজ আমার ছেলে বেঁচে আছে।’’

নিজের লিভারের অংশ ছেলেকে দিয়েছিলেন জিয়াউল। গত ১৪ অক্টোবর সুস্থ হয়ে এসএসকেএম থেকে বাড়ি গিয়েছেন মকসুদুল। এখন বিশ্রামে আছেন। জিয়াউল অবশ্য বাইরে কাজকর্ম শুরু করেছেন। মোটরবাইকও চালাচ্ছেন। এসএসকেএমের হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান অভিজিৎ চৌধুরীর মতে, ‘‘রোগীর মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তাতে যদি গোটা প্রচেষ্টা এবং চিকিৎসকদের লড়াইটাকে ছোট করা হয়, তা হলে সেটা আরও দুর্ভাগ্যজনক।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ছন্দা গায়েন পাহাড়ের পথে হারিয়ে গেলেও কিন্তু পর্বতারোহণ বন্ধ হয়নি। লিভার প্রতিস্থাপনের পরে শচীনন্দন মিশ্রের মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা। তাঁর লিভার ঠিক ছিল, আচমকা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হলেন। এটা আগে থেকে বোঝা যায় না। আর এই মৃত্যুর জন্য ভবিষ্যতে আর কোনও সফল প্রতিস্থাপন হবে না, এমনটা ভাবাও বোকামি।’’

এসএসকেএম হাসপাতালেই ২০১১ সালে লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছিল বছর দশেকের অনিমেষ বাগদির। বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদের বিছুর গ্রামে। গরিব রাজমিস্ত্রি ভূদেব বাগদির বড় ছেলে অনিমেষ। ছেলেকে লিভারের অংশ দিয়েছিলেন তার মা ছবি বাগদি। টেলিফোনে ভূদেব জানান, ছেলে আর স্ত্রী দু’জনেই একেবারে সুস্থ আছেন। এসএসকেএমেই লক্ষ্মীকান্তপুরের সুভাষ হালদারের লিভার প্রতিস্থাপন হয় ২০১৫ সালে। দাতা ছিলেন স্ত্রী মিঠু। দু’জনেই সুস্থ আছেন, ভাল আছেন।

এঁদের থেকে জীবনের গল্পটা অন্য রকম রাসবিহারী কানেক্টর অঞ্চলের বাসিন্দা গায়ত্রী বিশ্বাসের। ২০১১ সালে তাঁর স্বামী বিমলচন্দ্র বিশ্বাসের লিভার প্রতিস্থাপন হয় এসএসকেএমে। নিজের লিভারের অংশ তাঁকে দেন গায়ত্রীদেবী। কিন্তু বিমলবাবু বাঁচেননি। তখন গায়ত্রীদেবীর বয়স মাত্র ৩৮। চিকিৎসা পদ্ধতির উপর থেকে তাঁর আস্থা উঠে যাওয়াটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তার উল্টোটাই হয়েছে। তিনি জোরের সঙ্গে বলতে পারছেন, ‘‘শুধু ব্যর্থতা দেখব কেন? দেখতে হবে চেষ্টাটাকে। এসএসকেএমে তো সাফল্যের নজিরও আছে।। তা ছাড়া, এ বার যে ভাবে গ্রিন করিডর করে মৃতের দেহ থেকে তিনটি অঙ্গ তোলা হল, তাকে বাহবা দিতে হবে। এতটুকু অগ্রসর হতেও তো আমাদের অনেক বছর লেগেছে।’’

ধাক্কা এলেও তাই ভরসা থাকছে প্রচেষ্টায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন