TMC

একদা কংগ্রেসের ঘাঁটি তিনটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় ‘বিশেষ নজর’ দিচ্ছে তৃণমূল, মেপে পা ফেলছেন অভিষেক

গত দেড় দশক ধরে সংখ্যালঘুদের সমর্থনকে পুঁজিতে পরিণত করেছে তৃণমূল। কিন্তু বিশদে পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই তিন জেলার সংখ্যালঘুদের সমর্থন তৃণমূলের দিকে আসতে সময় নিয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:০৮
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর— এক দশক আগেও এই তিন জেলাকে কংগ্রেসের ‘ঘাঁটি’ হিসাবে অভিহিত করা হত। সময়ের সঙ্গে কংগ্রেস তাদের শক্তি হারিয়েছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই তিন জেলাতেই গণভিত্তি পোক্ত করেছে তৃণমূল। কিন্তু ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সেই তিনটি জেলাতেই ‘বিশেষ নজর’ দিতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল। ঘটনাচক্রে, এই তিন জেলার ক্ষেত্রে তিনটি ‘অভিন্ন’ বিষয় রয়েছে। প্রথমত, তিন জেলাতেই ধর্মীয় মেরুকরণের আবহ তীব্র। দ্বিতীয়ত, শাসকদলের সংগঠনে অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি গোষ্ঠীকোন্দল। তৃতীয়ত, শূন্য থেকে খাতা খোলার লক্ষ্যে এই তিন জেলাকেই তাদের জন্য উর্বর ধরে নিয়ে অঙ্ক কষছে বিরোধী বাম এবং কংগ্রেস।

Advertisement

এই সাত-সতেরো মাথায় রেখেই সংগঠনকে বিধানসভা ভোটের জন্য প্রস্তুত করছে তৃণমূল। ব্লক স্তরের রদবদলে তার ছাপও দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ব্লক স্তরের রদবদলে মুর্শিদাবাদের ছবি দেখে শাসকদলের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, মুর্শিদাবাদ নানা কারণে তৃণমূলের জন্য ‘কণ্টকাকীর্ণ’। সে কারণেই সতর্ক হয়ে পা ফেলতে চাইছে দল। বলা ভাল, সতর্কতা দেখাচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, রদবদলের প্রক্রিয়ায় তাঁর ভূমিকাই মুখ্য। যাতে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রশাসনিক ভাবে মুর্শিদাবাদ একটি জেলা হলেও সাংগঠনিক ভাবে মুর্শিদাবাদকে দু’টি জেলায় ভেঙে দল পরিচালনা করে তৃণমূল। একটি বহরমপুর এবং অন্যটি জঙ্গিপুর। শনিবার এক লপ্তে ন’টি জেলার রদবদল করে ফেলেছে তৃণমূল। তার মধ্যে রয়েছে এই দুই জেলাও। অন্য জেলাগুলির তুলনায় তালিকার ছবি কিছুটা ভিন্ন মুর্শিদাবাদে। বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার অন্তর্গত ভরতপুরের দু’টি ব্লকে মূল দলের পাশাপাশি যুব, মহিলা এবং শ্রমিক সংগঠনের সভাপতিদের নাম ঘোষণা করেনি তৃণমূল। তালিকায় লেখা রয়েছে, পরে ঘোষণা করা হবে। আবার জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলার অন্তর্গত সাগরদিঘিতে মূল দলের সংগঠনে কাউকে সভাপতি করা হয়নি। তার বদলে কোর কমিটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। একই পন্থা নেওয়া হয়েছে লালগোলার ক্ষেত্রেও।

Advertisement

সাগরদিঘি তৃণমূলকে ‘ধাক্কা’ দিয়েছিল। রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সাহার প্রয়াণের পরে ২০২৩ সালে উপনির্বাচন হয়েছিল সাগরদিঘিতে। আপাতনিরীহ সেই উপনির্বাচনে তৃণমূলকে হারিয়ে দিয়ে জিতে গিয়েছিলেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। তার পরে অবশ্য বাইরন কয়েক মাসের মধ্যে তৃণমূলে যোগ দেন। কিন্তু সেই হারের পরে তৃণমূলের সাংগঠনিক ময়নাতদন্তে উঠে এসেছিল ব্লক স্তরে গোষ্ঠীবাজির তথ্য। জেলার রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের মতে, সেই ধারায় এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি। সে কারণেই একক ভাবে কাউকে সভাপতি না-করে কোর কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছে। যার আহ্বায়ক করা হয়েছে বিধায়ক বাইরনকে। আবার লালগোলার কোর কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেখানে বিধায়ক মহম্মদ আলি নেই। তাঁর নাম নেই কমিটিতেও। যদিও আলি বলছেন, তিনি বিধায়ক হিসাবে বিধানসভা এলাকার সংগঠনের চেয়ারম্যান। তাই পৃথক ভাবে তাঁর নাম তালিকায় উল্লিখিত নেই। তবে তৃণমূল সূত্রে খবর, এক আইনজীবী নেতাকে কেন্দ্র করে লালগোলাতেও গোষ্ঠীকোন্দল প্রবল। সে কারণেই কোর কমিটি।

এর আগে জেলা সংগঠনে গোষ্ঠীকোন্দল সামাল দিতে বীরভূমে কোর কমিটি গড়েছে তৃণমূল। যে জেলায় অনুব্রত মণ্ডল বনাম কাজল শেখের গন্ডগোল সুবিদিত। একই ধাঁচে কোর কমিটি গড়া হয়েছে উত্তর কলকাতাতেও। যেখানে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কুণাল ঘোষের মতো নেতাদের দ্বন্দ্ব তৃণমূলকে বারংবার ‘বিড়ম্বিত’ করেছে।

ভরতপুরের দু’টি ব্লকেই দলীয় সংগঠনের পাশাপাশি শাখা সংগঠনের সভাপতিদেরও নাম ঘোষণা করা হয়নি। কেন? গড়ে মাসে এক বার করে দলের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠা তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর বলছেন, ‘‘কেন করেনি তা রাজ্য নেতৃত্ব বলতে পারবে। আমি জানি না।’’ তবে তিনি এ নিয়ে এখনই কোনও বিদ্রোহ করছেন না। হুমায়ুন-ঘনিষ্ঠ এক যুব নেতার কথায়, ‘‘দাদার মূল অভিযোগ ছিল ব্লক সভাপতিদের বিরুদ্ধে। যাঁরা সেই পদে ছিলেন, তাঁদের জেলা কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে। যা থেকে দাদা অনুমান করছেন, তিনি যে নাম প্রস্তাব করেছিলেন এবি (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়)-র কাছে, তাতেই সিলমোহর পড়বে।’’

অন্য দিকে, মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরেও বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে শাসকদলের সংগঠনে। ২০১৯ সালে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ লোকসভায় প্রথম জিতেছিল বিজেপি। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই ‘ক্ষত’ মেরামত করে তৃণমূল। জেলার ন’টি বিধানসভার মধ্যে তৃণমূল জেতে সাতটিতে। রায়গঞ্জ আর কালিয়াগঞ্জ জেতে বিজেপি। কিন্তু ২০২৪ সালে বিজেপি আবার লোকসভায় জেতে। উত্তর দিনাজপুরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে রায়গঞ্জ শহরের ফলাফল নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন অভিষেক। এই জেলাতেও কোন্দল রয়েছে নেতাদের মধ্যে। বিহারের লাগোয়া এই জেলায় সংখ্যালঘু অংশের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিরও প্রভাব রয়েছে।

মালদহে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে শোচনীয় ফলাফল হয়েছিল তৃণমূলের। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মালদহ উত্তর লোকসভা জেতে বিজেপি। মালদহ দক্ষিণ কংগ্রেস। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই ‘ধাক্কা’ সামলে জেলার ১২টির মধ্যে আটটিই জেতে তৃণমূল। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও মালদহের দু’টি আসনে হারে তারা। মালদহের তৃণমূলে গোষ্ঠীকোন্দলও সুবিদিত। সেই লড়াই খুনোখুনি পর্যন্ত গড়িয়েছে। অভিষেক মালদহের নেতাদের গোষ্ঠীকোন্দল দ্রুত মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন বটে। কিন্তু শেষমেশ কী হবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তিনি মনে করেন মালদহের খারাপ ফলাফলের জন্য গোষ্ঠীকোন্দলই দায়ী। মালদহে মেরুকরণের আবহও চরমে। বুধবার পর্যন্ত মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুরের ব্লক স্তরের রদবদলের ঘোষণা করেনি তৃণমূল। তবে শীঘ্রই তা করবে বলে খবর। সেই রদবদলের ক্ষেত্রেও ব্লকের সমীকরণ অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে বলেই জানাচ্ছে একাধিক সূত্র। গোষ্ঠীকোন্দল মেটাতে রদবদলে নানা ব্লকে নানা কৌশল নিতে পারে তৃণমূল।

এ কথা ঠিক যে, গত দেড় দশক ধরে সংখ্যালঘুদের সমর্থনকে পুঁজিতে পরিণত করেছে তৃণমূল। আবার পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই তিন জেলার সংখ্যালঘুদের সমর্থন তৃণমূলের দিকে আসতে সময় নিয়েছে। ২০১১ সালে পালাবদলের পর ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত, ২০১৪ সালের লোকসভা এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত এই তিন জেলার সংখ্যালঘুদের ব়ড় অংশের সমর্থন ছিল বাম-কংগ্রেসের দিকে। দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, দুই মেদিনীপুরের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর দিনাজপুরের সংখ্যালঘু সমর্থন তৃণমূলের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের ফারাক রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভায় কিছুটা বদল হয়েছিল। ২০২১ সালে সংখ্যালঘুদের সার্বিক সমর্থন যায় তৃণমূলের দিকে। আবার মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে এই তিন জেলাতেই ভোট শতাংশের নিরিখে ভাল জায়গায় রয়েছে বিজেপি। এ হেন নানা অঙ্ক মাথায় রেখেই এই তিন জেলার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিচ্ছে তৃণমূল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement