(বাঁ দিকে) বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বনমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন মামলায় আদালতে রাজ্য সরকারের ‘ধাক্কা’ খাওয়া যখন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন ভিন্ন দৃষ্টান্ত তৈরি হল শুক্রবার। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অন্তর্বর্তী রক্ষাকবচ প্রত্যাহার করে নিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত। যাকে অনেকেই শুভেন্দুর ‘ধাক্কা’ হিসাবে অভিহিত করছেন। এই ‘সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে’ শুভেন্দুর উপর চাপ বৃদ্ধি করতে আরও আগ্রাসী হতে চলেছে তৃণমূল। আইনি দিক থেকে মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদার মামলা আগামী দিনে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের ‘শক্তিশালী অস্ত্র’ হতে পারে বলে মনে করছেন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা।
শুভেন্দুর বিরুদ্ধে থাকা ২৬টি মামলার মধ্যে ১৫টি শুক্রবার খারিজ করে দিয়েছে হাই কোর্ট। তবে বাকি মামলা চলবে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় সিবিআই এবং রাজ্য পুলিশের কর্তাদের নিয়ে যৌথ বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য সরকারের হয়ে শুক্রবারের শুনানিতে সওয়াল করেন আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রায়ের পর তিনি বলছেন, ‘‘বিরবাহা হাঁসদা যে অভিযোগ করেছিলেন, সেই মামলায় শুভেন্দুর বিরুদ্ধে পুলিশ পদক্ষেপ করতেই পারে। তাতে কোনও বাধা নেই।’’ আইনজীবীদের আরও কেউ কেউ মনে করছেন, বিরবাহার মামলায় শুভেন্দুকে চাপে ফেলার সুযোগ রয়েছে শাসকের।
বিরবাহা আদিবাসী সমাজের থেকে উঠে আসা জনপ্রতিনিধি। অভিযোগ ছিল, তাঁকে আক্রমণ করতে গিয়ে শুভেন্দু আদিবাসীদের অপমান করেছেন। রাজ্য সরকারের বক্তব্য, হাই কোর্টের রক্ষাকবচের জন্যই এসটি-এসসি আইনের ওই মামলায় পদক্ষেপ করা যায়নি। আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি শুভেন্দুর বিরুদ্ধে পুরনো মন্তব্য সমাজমাধ্যমের প্রচারেও তুলে ধরার পরিকল্পনা করছে তৃণমূল।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা শুভেন্দুকে রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টেরও দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু শীর্ষ আদালত সেই মামলাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল হাই কোর্টেই। শুক্রবার বিচারপতি সেনগুপ্ত বলেছেন, অন্তর্বর্তী নির্দেশ দীর্ঘ দিন বহাল থাকতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ১৫টি মামলা খারিজ করে দিলেও, বাকি মামলাগুলিতে শুভেন্দুর রক্ষাকবচ বাতিলেরও নির্দেশ দেন তিনি।
তৃণমূল মনে করছে, ওই রক্ষাকবচের জোরেই শুভেন্দু বেপরোয়া হয়ে নানাবিধ মন্তব্য করছিলেন। যা সার্বিক ভাবে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। এই রায়ের ফলে শাসকদল সাংগঠনিক ভাবেও উজ্জীবিত। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘আদালতে গিয়ে শুভেন্দু যা যা সুবিধা পেয়েছেন, তাতে আমাদের কর্মীদেরও মনোবল ভাঙছিল। এই রায় তা অনেকটাই কাটাবে।’’ তৃণমূলের আরও বক্তব্য, শুভেন্দুর দেহরক্ষীর রহস্যমৃত্যু, কনভয়ের ধাক্কায় এক জনের মৃত্যু, ধর্ম নিয়ে নানাবিধ ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্য নিয়ে পুলিশ পদক্ষেপ করতে পারেনি আদালতের রক্ষাকবচের কারণেই। এখন সেই বাধা রইল না। তৃণমূল মনে করছে, শুক্রবার আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে শুভেন্দুকে আপাতত দমে যেতে হবে। যদিও বিরোধী দলনেতার কোনও বক্তব্য থাকলে তা সোমবারের মধ্যে লিখিত ভাবে জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট।
বিরোধী দলনেতার অভিযোগ ছিল, তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক এফআইআর করছে পুলিশ। ছোটবড় যে কোনও ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এফআইআরগুলিকে ভুয়ো বলে উল্লেখ করে ২০২১ এবং ২০২২ সালে দু’বার হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন শুভেন্দু। সেই সময়ে বিচারপতি মান্থা এফআইআরগুলিতে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেন এবং জানান, আদালতের অনুমতি ছাড়া নতুন করে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর করা যাবে না। গোড়া থেকেই এই রক্ষাকবচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তৃণমূল। শাসকদলের বক্তব্য ছিল, ভবিষ্যতের জন্য কী ভাবে রক্ষাকবচ দিতে পারে আদালত? প্রকাশ্যে বিচারপতি মান্থার রায়ের সমালোচনা করেছিলেন তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই নির্দেশ প্রত্যাহার হল বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে। ফলে কোমর বাঁধছে তৃণমূল।