Mamata Banerjee on ‘INDIA’

অধীরদের আক্রমণে না গিয়ে সনিয়া-রাহুলদের বার্তা মমতার, ‘ইন্ডিয়া’র স্বার্থে সিপিএমেও নরম

বাম-কংগ্রেস-বিজেপিকে এক বন্ধনীতে ফেলে যে যে বিশেষণ ব্যবহার করতেন, বেঙ্গালুরু-বৈঠকের পরে তা করেননি মমতা। কংগ্রেসকে আক্রমণ না-করে বার্তা দিচ্ছেন, তাঁর অগ্রাধিকার এখন ‘ইন্ডিয়া’।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ০০:০০
Share:

মমতার কৌশলে কি চাপ বেড়ে গেল অধীরদের? ছবি: ফেসবুক।

কংগ্রেসকে কোনও আক্রমণ নেই। সিপিএমের নাম নিলেন বটে। কিন্তু তাতে সে ভাবে ঝাঁজ ছিল না। শুক্রবার ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৪৩ মিনিটের বক্তৃতার ‘রাজনৈতিক নির্যাস’ এটিই। যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, তৃণমূলের সর্বময় নেত্রীর কাছে এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’। তাঁর কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বিজেপির বিরোধী জোট এবং তার শরিকেরা।

Advertisement

শুক্রবার একটি বারই মমতা তাঁর বক্তৃতায় বামেদের প্রসঙ্গ টানেন। তা-ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার প্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানার সঙ্গে। মমতা বলেন, ‘‘বুদ্ধদেববাবুর আমলে কী হয়েছিল? মমতার নামে আপনাদের তো চিরকাল ‘অ্যাল্যার্জি’! ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৮ সালে ভোটের দিনে ৩৯ জন মারা গিয়েছিল। এ বার মারা গিয়েছেন ২৯ জন। তার মধ্যে তৃণমূলেরই ১৮ জন।’’ পঞ্চায়েত ভোটপ্রক্রিয়ায় ‘হিংসা’ এবং ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে সরকার তথা শাসকদলকে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। সেই কারণেই মমতা ওই তুলনা টেনেছেন। পাশাপাশিই, উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘‘৭১ হাজার বুথে ভোট হয়েছে। ভাঙড়ে হাঙরেরা গোলমাল করেছে। ডোমকলে গোলমাল হয়েছে। সেখানে আমরা হেরেছি। চোপড়া-ইসলামপুরে আর কোচবিহারে গোলমাল হয়েছিল। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখিত।’’ আর বক্তৃতার শেষ দিকে বলেছেন, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েতগুলো সিপিএমের সরকারের কায়দায় কাজ করবে না। আমাদের সরকারের মতো করবে।’’ এই পর্যন্তই! যা তুলনায় অনেক ‘নরম’ বলেই অনেকে মনে করছেন।

মমতার বক্তৃতায় আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। পঞ্চায়েত ভোটের প্রসঙ্গে সিপিএমের চেয়ে তিনি মোদীকে বিঁধেছেন অনেক বেশি তীক্ষ্ণতায়। কৌশলে সেই সমালোচনার সঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গটিও জুড়ে দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘উনি রাজস্থান, ভোপাল— সর্বত্র গিয়ে বাংলার নিন্দা করে বেড়াচ্ছেন। মোদীজি, আপনি বাংলার বদনাম করছেন। বাংলাকে অসম্মান করছেন।’’ তবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রীর থেকে শুক্রবার মমতা বেশি করে চোখে পড়েছেন ‘ইন্ডিয়া’-র (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) প্রতিনিধি হিসাবে। বাংলায় বক্তৃতার মধ্যে বিশেষ বিশেষ জায়গায় ব্যবহার করেছেন হিন্দি ভাষা। বলেছেন, ‘‘হিন্দুস্থান জিতেগা, মোদী হারেগা, ভাজপা হারেগা।’’

Advertisement

জোটের প্রেক্ষাপট এবং এই ২১ জুলাই

গত মঙ্গলবারই বেঙ্গালুরুতে ২৬ দলের জোটের বৈঠকে যোগ দিয়ে ফিরেছেন মমতা। সেই দিনেই জন্ম নিয়েছিল বিরোধী নতুন জোট ‘ইন্ডিয়া’। কংগ্রেস এবং বামেরা বাংলায় মমতার প্রতিপক্ষ হলেও জাতীয় স্তরের ওই জোটে তৃণমূলের শরিক। শুক্রবারের বিশাল সমাবেশে দিল্লি এবং বাংলার রাজনীতিতে তাঁর রাজনৈতিক লড়াইয়ের ‘নীতিগত অবস্থান’ মমতা স্পষ্ট করবেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা ছিল তৃণমূলের ভিতরেও। সরাসরি না হলেও সেই নীতি স্পষ্ট করে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। আক্রমণ শানালেন শুধু প্রধানমন্ত্রী মোদীর নাম করে। আর কারও নয়। এমনকি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কথাও শোনা যায়নি মমতার মুখে। বার বার তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, লক্ষ্য দিল্লির সরকার বদল। লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী বদল।

পাশাপাশিই জানিয়ে দিলেন, জোটর ‘মুখ’ হতে তৃণমূলের আলাদা কোনও বাসনা নেই। মমতা বলেছেন, ‘‘আমরা ইনক্লুসিভ (সম্মিলিত) জোট তৈরি করতে পেরেছি। সবটাই ‘ইন্ডিয়া’র ব্যানারে হবে।’’ আরও বলেছেন, ‘‘আমরা চেয়ারকে কেয়ার করি না। ‘ইন্ডিয়া’ লড়বে। তৃণমূল কংগ্রেস পাশে সৈনিকের মতো ঝান্ডা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিজেপি দেশ থেকে রাজনৈতিক ভাবে বিদায় নিক। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সব সীমা পার করে গিয়েছে।’’ অর্থাৎ, মমতা আর ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’-র কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলা শুরু করেছেন।

মমতার অস্ত্র মণিপুর

বস্তুত, মমতার বক্তৃতায় মূলত জাতীয় স্তরের বিষয়গুলিই প্রাধান্য পেয়েছে। রান্নার গ্যাস থেকে টোম্যাটোর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যেমন আক্রমণ করেছেন মোদী সরকারকে, তেমনই কিন্তু বিজেপি-বিরোধী জোট যে সার্বিক ভাবে মণিপুর ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘কোণঠাসা’ করতে চাইবে, তা-ও মমতার বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বক্তৃতার শুরুতেই ‘বাংলা ও ইন্ডিয়ার পক্ষে’ মণিপুরের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন। এর পরেই মোদীকে আক্রমণ করে বলেছেন, ‘‘বেটি বঁচাও স্লোগান দিয়েছিলেন! মণিপুরে যা চলছে, বেটি জ্বালানো হচ্ছে। মণিপুর জ্বলছে, গোটা দেশ জ্বলছে। বিলকিসের খুনিকে ছেড়ে দিয়েছেন। কুস্তিগিরদের অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তাঁকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’’

মণিপুর নিয়ে মমতার লাগাতার আক্রমণে বিজেপি ‘চাপে’, সেটা বোঝা গিয়েছে তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে পরেই রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দিল্লি থেকে সাংবাদিক বৈঠক করায়। সেখানে সুকান্ত অভিযোগ করেছেন, ‘‘বাংলাতেও মহিলারা অত্যাচারিত। মণিপুরের সঙ্গে একটাই ফারাক যে, তার কোনও ভিডিয়ো নেই।’’

অভিষেকের মুখেও ‘ইন্ডিয়া’

আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার প্রাপ্য টাকা আদায়ের জন্য ‘দিল্লি চলো’র ডাক দেওয়ার পাশাপাশি লোকসভা নির্বাচনে দিল্লি দখলেরও ডাক দিয়েছেন। শুধু নিজে বলাই নয়, সমাবেশে হাজির কর্মী-সমর্থকদের দিয়েও ‘ইন্ডিয়া’ স্লোগান বলিয়ে নিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

কোচবিহার, কাকদ্বীপ নিয়ে স্লোগান শুরু করেছিলেন অভিষেক। একটা সময়ে চলে যান তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে। তখনই সিপিএমের কেরলেও ‘ইন্ডিয়া’কে জেতানোর স্লোগান শোনা যায় তৃণমূলের সমাবেশে। অভিষেক বলেন, ‘‘কেরলে জিতবে কে?’’, সমাবেশ বলে, ‘‘ইন্ডিয়া, আবার কে!’’ অভিষেক বলেন, ‘‘গোটা দেশে জিতবে কে?’’ সমাবেশ বলল, ‘‘ইন্ডিয়া, আবার কে!’

মমতার কৌশলে ‘চাপ’ বাড়ল অধীরদের?

এই সেদিন পর্যন্তও বাম-কংগ্রেস-বিজেপিকে এক বন্ধনীতে ফেলে যে যে বিশেষণ ব্যবহার করতেন, বেঙ্গালুরুর বৈঠকের পরে তা করেননি মমতা। অর্থাৎ, তিনি কংগ্রেসকে আক্রমণ না-করে বার্তা দিয়েছেন যে, তাঁর অগ্রাধিকার এখন ‘ইন্ডিয়া’। পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় রাজনীতি নয়। তৃণমূল নেত্রীর এই ‘কৌশলে’ কি ‘চাপ’ বাড়ল প্রদেশ কংগ্রেসের উপর?

অনেকেই কৌতূহলী, মমতা যদি এ রাজ্যে কংগ্রেসকে আক্রমণই না করেন, তাহলে অধীর চৌধুরীরা কী করে তাঁকে পাল্টা রাজনৈতিক আক্রমণ করবেন! মমতার বক্তৃতা থেকে স্পষ্ট যে, তিনি বিজেপির বিরোধী জোট নিয়ে ‘ইতিবাচক’ ভূমিকাই নিতে চাইছেন। সে কারণেই কংগ্রেসকে আক্রমণ করেননি। সিপিএমকে করলেও তাতে সেই ‘ঝাঁজ’ রাখেননি।

কী বললেন অধীর?

প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ঘরোয়া আলোচনায় রাজ্য কংগ্রেসের অনেক নেতাই স্বীকার করে নিচ্ছেন, তৃণমূলের এই ‘কৌশল’ তাঁদের জন্য কিছুটা ‘অস্বস্তি’র। তৃণমূল রাজনৈতিক ভাবে আক্রমণ না করলে কংগ্রেস কী করে তাদের বা মমতাকে পাল্টা আক্রমণ করবে? আগ বাড়িয়ে তা করতে গেলে বিজেপি বিরোধী পরিসরেও মানুষের কাছে ‘সঠিক বার্তা’ যাবে না।

যদিও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এই বিষয়টিকে ‘চাপ’ হিসাবে মানতে চাননি। বহরমপুরের সাংসদ তথা লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা বলেন, ‘‘আমরা তো রোজ তৃণমূলের কাছে শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হচ্ছি। উনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) মৌখিক আক্রমণ করলেন কি করলেন না, তাতে কী এসে গেল!’’ বরং অধীরের ব্যাখ্যা, ‘‘কংগ্রেসের নামে কিছু বললে লোকে ছ্যা-ছ্যা করবে! সেটা বুঝতে পেরেই ওই পথে হাঁটেননি তৃণমূল নেত্রী।’’ মুর্শিদাবাদের ‘অধীর-ঘনিষ্ঠ’ কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তীও কটাক্ষে ‘ঝাঁজ’ দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘মমতা এক সময়ে কংগ্রেসকে পচা ডোবা বলেছিলেন। এখন সেই ডোবাতেই তাঁকে নামতে হয়েছে!’’

বাদাম এবং ‘শ্বেতপতাকা’

বেঙ্গালুরুর বৈঠকের পর দেখা গিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বয়াম থেকে বাদাম ঢেলে দিচ্ছেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী। বৈঠক শেষের সাংবাদিক সম্মেলনে রাহুলকে ‘ওযার ফেভারিট’ (আমাদের প্রিয়) বলে সম্বোধন করেছিলেন মমতা। যা দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্ব ঘুচে যাওয়ার লক্ষণ হিসাবেই দেখা হচ্ছিল। কারণ, এর আগে নাম না করে রাহুলকে ‘বসন্তের কোকিল’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন মমতা।

গত পাঁচ-সাত বছরের ২১ জুলাইয়ের সভায় তৃণমূল নেত্রী নিয়ম করে বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছেন। সম্প্রতিও তিনটি দলকে ‘‘জগাই, মাধাই, গদাই। দুই দিকে দুই কলাগাছ মধ্যিখানে মহারাজ’’ বলেও আক্রমণ করেছেন। কিন্তু শুক্রবার সে সব পথে হাঁটেননি মমতা। কংগ্রেস নিয়ে কিছু বলেননি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এখন দেখার, মমতা ‘সাদা পতাকা’ তোলার পরেও কংগ্রেস তাঁকে আক্রমণ করে কি না। করলে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড বিষয়টি সম্পর্কে কী পদক্ষেপ করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন