—প্রতীকী ছবি।
মুসলিমদের তিন তালাক প্রথা বন্ধের প্রশ্নে দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক চললেও এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অবস্থান জানাতে গিয়ে কৌশলে ধোঁয়াশা রেখে দিল পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস।
বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থান জানতে চাওয়া হলে শনিবার দলের রাজ্যসভার নেতা তথা দলীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘দেশের সংবিধানই আমাদের পথ প্রদর্শক। ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশ। এই মহান দেশে সব ধর্মের বিশ্বাস ও প্রথাকে সর্বদাই মর্যাদা দেওয়া উচিত।’’
সন্দেহ নেই, সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সবার উপরে রাখলে তালাক বিতর্কে সুপ্রিম কোর্টে যে শুনানি চলছে, তার উপরে ভরসা রাখার কথাই বলা হয়। অর্থাৎ তালাক প্রথা বন্ধের ব্যাপারে সব পক্ষের থেকে মতামত নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দেবে, তাকেই মেনে নেবে তৃণমূল। ফলে ডেরেকের মন্তব্যের প্রথম অংশ নিয়ে কোনও ধন্দ নেই। কিন্তু এর পরেই সব ধর্মের বিশ্বাস ও প্রথাকে মর্যাদা দেওয়ার কথা যে ভাবে তৃণমূলের তরফে বলা হয়েছে, তাতেই শাসক দলের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ডেরেক অবশ্য দলের ওই অবস্থানের অতিরিক্ত আর কোনও ব্যাখ্যা দিতে চাননি।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, দলীয় তরফে এমন ধোঁয়াশা রাখা হলেও তালাক প্রথা তুলে দেওয়ার ‘ষড়যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে এ দিন সরব হয়েছেন তৃণমূলেরই অন্যতম সংখ্যালঘু মুখ তথা দলের সহ সভাপতি সুলতান আহমেদ। তৃণমূল সাংসদ হওয়ার পাশাপাশি সুলতান ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডে’র সদস্যও বটে। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে দলের সঙ্গে এখনও আমার কোনও আলোচনা হয়নি ঠিকই। তবে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডে’র সদস্য হিসেবে বলছি, সরকার ইনিয়ে-বিনিয়ে শরিয়ত আইনে মাথা গলাতে চাইছে। বিজেপির চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নতুন নয়। অতীতে বাজপেয়ী জমানাতেও এই চেষ্টা হয়েছিল। এখন মোদী সরকারও তিন তালাক বন্ধের নামে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কায়েম করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’’
বস্তুত তিন তালাক প্রথার পক্ষে এ দিন সওয়ালও করেন সুলতান। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘শরিয়ত আইন মেনে চলা মুসলিমদের মৌলিক অধিকার। এই আইনের সঙ্গে মুসলিম মহিলাদের উত্তরাধিকারের বিষয়টিও জড়িত রয়েছে। তা ছাড়া একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে, মহিলাদের ওপর অত্যাচার বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার বিরুদ্ধে পার্সোনাল ল বোর্ড কখনও কিন্তু প্রশ্ন তোলেনি।’’
পর্যবেক্ষকদের মতে, আসলে চলতি বিতর্ক নিয়ে কৌশলী অবস্থান রেখে চলছে তৃণমূল। এমন নয় যে সব মুসলিমই তালাক প্রথার পক্ষে। উদার মুসলিম এবং মুসলিম মহিলাদের বড় অংশই এই প্রথার ঘোর বিরোধী। তাই সংবিধানের ওপরে বিশ্বাস রাখার কথা তৃণমূলকে বলতেই হচ্ছে। একই সঙ্গে মুসলিম কট্টর ভাবাবেগকেও তুষ্ট রাখতে চাইছে তৃণমূল। সেই কারণেই সুলতান আহমেদের মতো সংখ্যালঘু নেতার মাধ্যমে কেন্দ্রের তৎপরতার বিরুদ্ধে সমালোচনার রণনীতি নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, তিন তালাক প্রথার বিলোপের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। মুসলিম মহিলাদের সংগঠন সেই মামলা করেছে। তার ভিত্তিতেই সম্প্রতি এ ব্যাপারে আদালত কেন্দ্রের মতামত জানতে চেয়ে নোটিস দেয়। এর পরই জাতীয় আইন কমিশন তিন তালাক এবং বহুগামিতা নিয়ে একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে পার্সোনাল ল বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপকে মোদী সরকারের স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে আইন কমিশনের প্রশ্নমালা বয়কটের জন্য ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড। সুলতান এ দিন জানান, আগামী মাসের ১৮ তারিখ থেকে তিন দিন ধরে কলকাতায় মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সম্মেলন হবে। গোটা দেশের আড়াইশরও বেশি মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত থাকবেন। সম্মেলনে আইন কমিশনের প্রশ্নমালার ব্যাপারেও আলোচনা হবে। তার পর চূড়ান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করবে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড।
তবে পার্সোনাল ল বোর্ডের এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধ মতও তৈরি হচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে থেকেই। আইন কমিশনের প্রশ্নমালা বয়কট করায় বোর্ডের বিরুদ্ধে এ দিনও ক্ষোভ উগরে দিয়েছে দেশের মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলি। তাদের অভিযোগ, শরিয়ত আইনকে বিকৃত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতি করছে ল বোর্ড। সুলতান আহমেদরা যখন শরিয়ত আইনের দোহাই দিচ্ছেন, তখন লখনউয়ে মুসলিম মহিলা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট নাজিম আনসারি বলেন, ‘‘মহিলাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠলেই শরিয়ত প্রসঙ্গ টেনে আনা হয় কেন? ধর্ষণ বা সমতুল্য কোনও জঘন্য কাজে যুক্ত অপরাধীদের শাস্তির বেলায় শরিয়তের বিধান কেন সামনে আসে না?’’ মহিলারা যাতে ল বোর্ডের প্রশ্নমালায় নিজেদের মত জানাতে পারেন, তার জন্য দেশব্যাপী প্রচারের ডাক দিয়েছেন ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের সদস্য জাকিয়া সোনম। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সংগঠন মুসলিম মহিলাদের মধ্যে ৫০ হাজার ফর্ম বিলি করবে। ১৫টি রাজ্যে সংগঠনের শাখা এই কাজ করবে। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের মত প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে আইন কমিশন।’’
এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, বিষয়টি যে ক্রমশ জটিল আকার নিতে চলেছে এর থেকেই পরিষ্কার। তাই তৃণমূলের তরফেও কৌশলী অবস্থান নেওয়া হয়েছে। কে কীভাবে এর ব্যাখ্যা করবে সেটা তাঁর ব্যাপার!