আয়নার কুয়াশা কাটাতে ইংরেজি শিখছেন ওঁরা 

লম্বাটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন মেমসাহেব— সক্কলে আছে, শুধু তিনি নেই!

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ

লালবাগ শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:৩১
Share:

খোশমেজাজে: বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে স্থানীয় গাইড। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

লম্বাটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন মেমসাহেব— সক্কলে আছে, শুধু তিনি নেই!

Advertisement

শীতের দুপুরে হাজারদুয়ারির দরজায় দরজায় পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, ‘ক্যান এনি ওয়ান প্লিজ এক্সপ্লেন, হোয়াই...’

ভরা ডিসেম্বরের হাজারদুয়ারি প্ল্যলেস জুড়ে বিনবিনে ভিড়। দু-এক জন মেঠো গাইড ঝাঁক বাঁধা কিছু স্কুল পড়ুয়াকে নিয়ে প্রাসাদের আনাচকানাচ ঘুরছিলেন বটে, তবে স্কটিশ মহিলার কেতাবি ইংরেজির মুখোমুখি হওয়ার বদলে তাঁরা আড়াল খুঁজলেন। সেলফি তোলার ভিড় থেকে দু-এক জন এগিয়ে এলেন বটে, তবে তাঁদের আটপৌরে ইংরেজি তজর্মায় সেই মায়া-আয়নার কুয়াশা কাটল না। মাথা নিচু করে ফিরে যাওয়ার আগে বিদেশিনির আক্ষেপটা এখনও বুঝি হাজারদুয়ারির সিঁড়িতে লুটিয়ে রয়েছে, ‘ইনএক্সপ্লিকেবল...’।

Advertisement

বছর কয়েক আগে, ভাষা সমস্যায় গুটিয়ে থাকা হাজারদুয়ারির সেই গাইডকুলের একজন কার্তিক ঘোষ। অকপটেই বলছেন, ‘‘বড় লজ্জার দিন গেছে জানেন, নিজে গাইড অথচ বিদেশিরা ভিড় করলেই সিঁটিয়ে যাতেম, ইংরেজি জানি না তো!’’

দেড়-দুশো টাকার চুক্তিতে আম জনতার গাইড হয়ে আপামর হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ, কাটগোলা বাগান ঘুরিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে পুরনো ইতিহাস ঢেলে দেন যাঁরা তাঁদের অনেকেই বিদেশির ভিড় দেখলেই পিছিয়ে যান। মুর্শিদাবাদের এই নবাবি ইতিহাস যেন কোনও এক অদৃশ্য ক্লাইভের হাত ধরে সব তালগোল পাকিয়ে দেয় তাঁদের!

সেই ‘ভাষা-ভয়’ কাটাতে এ বার ‘স্পোকেন ইংলিশ’-এর ক্লাসে ভিড় করছেন তাঁরা। ফলও মিলছে, দু’শোর বদলে পাক্কা দু’হাজার। কামাল মোল্লা সেই সদ্য ইংরেজিতে সড়গড় গাইড। রাখঢাক না রেখেই বলছেন, ‘‘টানা দশ বছর বাংলা আর ভাঙা হিন্দিতেই মরসুমি পর্যটকদের সামলে এসেছি। হাঁ করে দেখতাম, সাহেব-মেম’রা আসছেন, তাঁদের বোঝাতে পারলেই পাঁচ-সাত গুণ বাড়তি আয়, অথচ ইংরেজি না-জানার ভয়ে গুটিয়ে থাকতাম।’’ এ বার তাই সাত সকালের স্পোকেন ইংলিশে ভয় দূর করছেন কামাল। কামালের চেয়ে এই দৌড়ে খানিক এগিয়ে বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, ‘‘শিখব যখন, তখন একটু ভাল জায়গা থেকেই না হয় শিখি, তাই কলকাতার একটি স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে কেতাদুরস্ত হয়েছি।’’ চলনে বলনে বদলে যাওয়া বিশ্বজিৎ গলায় বেশ আত্মবিশ্বাস ঢেলেই বলছেন, ‘‘আগে ছিল দু-তিনশো আয়, এখন ইওরোপ-আমেরিকার ট্যুরিস্ট ধরছি, পাক্কা দু’হাজার!’’

বহরমপুরের অলি-গলিতে ছড়িয়ে থাকা সকাল-সন্ধ্যার ইংরেজি বলার দু’ঘণ্টার ক্লাসেও সেই সুবাদে ভিড় বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, কামাল, গোপাল, কার্তিকের মতো অন্তত শ’খানেক ‘হাজারদুয়ারি গাইড’ এখন ডুব দিয়েছেন ইংরেজি শেখার সেই সব সান্ধ্য-ক্লাসে। আবেদনটা এসেছে পুরসভার কাছেও। মুর্শিদাবাদের পুরপ্রধান বিপ্লব চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘গাইডদের অনেকেই চাইছেন, পুরসভার তরফে ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা করা হোক।’’

মায়া-আয়নার কুয়াশাটা কাটাতে হবে তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন