তরুণ ঘোষ
প্রশাসনের অনুমতি নেই। নেই নজরদারিও। সেই সুযোগেই দিনের পর দিন বেআইনি ভাবে সমুদ্র সৈকতে চলছিল প্যারাসেলিং-এর মতো বিনোদন-ব্যবসা। মন্দারমণির সৈকতে রোমাঞ্চের সেই হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেননি তরুণ ঘোষ (৩৬)। বিনোদনের মাসুল গুনলেন নিজের প্রাণের বিনিময়ে!
রবিবার সকালে মন্দারমণিতে সমুদ্রের ধারে প্যারাসেলিংয়ের সময় ওই পর্যটকের প্যারাশ্যুট হাওয়ার তোড়ে আটকে যায় ৫০ ফুট উঁচু বাতিস্তম্ভে। প্যারাশ্যুটের দড়ি বাঁধা ছিল জিপে। চলন্ত সেই জিপের টানে উপড়ে এল স্তম্ভ। সটান নীচে পড়ে মারা গেলেন মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের বাসিন্দা ওই যুবক। এত বড় ঘটনার পরেও অবশ্য টনক নড়েনি জেলা পুলিশ-প্রশাসনের। অনির্দিষ্ট কালের জন্য মন্দারমণিতে প্যারাসেলিং পরিষেবা বন্ধ করে আর ‘বেঙ্গল স্পোর্টস’ নামে ওই সংস্থার যাবতীয় জিনিস বাজেয়াপ্ত করেই দায় সেরেছে জেলা পুলিশ। পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার বক্তব্য, ‘‘মৃতের পরিজনরা যদি অভিযোগ দায়ের করেন, তবে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার আগে ওই সংস্থার যাবতীয় জিনিস আমরা বাজেয়াপ্ত করেছি।’’
পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর করে কেন ব্যবস্থা নেবে না, কেন গ্রেফতার করা হবে না বেআইনি ভাবে বিনোদন কারবার চালানো ওই সংস্থার কর্তা-কর্মীদের, তার সদুত্তর মেলেনি।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, তরুণবাবু শনিবার সকালে তিন বন্ধুকে নিয়ে দিঘায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। রবিবার সকালে দিঘা থেকে তাঁরা একটি গাড়িতে মন্দারমণি ঘুরতে যান। তখনই প্যারাসেলিং করার সিদ্ধান্ত নেন তরুণবাবু ও তাঁর এক বন্ধু। এ দিন সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘলা। ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। এমন আবহাওয়ায় কোনও ভাবেই প্যারাসেলিং করার কথা নয়। নিয়ম না মেনেই চলছিল সে সব। নজরদারির জন্য ছিলেন না পুলিশ-প্রশাসনের কেউই। হাওয়ার তোড়ে প্যারাশ্যুটের কাপড়ও ঠিক ভাবে খুলছিল না। পরিস্থিতি বিপজ্জনক বুঝে একবার উপরে উঠেও চটজলদি নেমে আসেন তরুণবাবুর বন্ধু অমৃত ঘোষ।
ল্যাম্পপোস্টে তখনও জড়িয়ে প্যারাশ্যুটের কাপড়। মন্দারমণিতে সোহম গুহর তোলা ছবি।
এর পর ওই প্যারাসেলিং সংস্থার পক্ষ থেকেই তরুণবাবুকে একটি গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে। পিছনে নিজেদের গাড়িতে ছিলেন বন্ধুরা। কিন্তু মাঝপথে সংস্থার কর্মীরা বুঝতে পারেন মারা গিয়েছেন তরুণবাবু। সেই সময় নিজেদের গাড়ি থেকে পিছনের গাড়িতে তরুণবাবুর দেহ তুলে দিয়ে তাঁরা পালিয়ে যান বলে অভিযোগ। ইতিমধ্যে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসে পুলিশ। তরুণের বন্ধুদের অভিযোগ, পুলিশ তরুণবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে না গিয়ে সোজা রামনগর থানায় নিয়ে যায়। কেন এমন করা হল? মন্তব্য করতে চাননি রামনগর থানার ওসি অমিয় ঘোষ। শেষ অবধি এ দিন কাঁথি হাসপাতালে তরুণবাবুর দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। তাঁর পরিবারের লোকেরাও এসেছেন। বাড়িতে আছেন তাঁর স্ত্রী ও দুই স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে। এ দিনের দুর্ঘটনা অনেককেই মনে পড়িয়ে দিয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে দার্জিলিংয়ের রোপওয়ের দুর্ঘটনার স্মৃতি। একটি গোটা পরিবার কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই ঘটনায়। তার পরে বহু বছর রোপওয়ে বন্ধ ছিল। গত বছর তারে টিকি জড়িয়ে তিস্তা পার হতে গিয়ে সেবক ব্রিজের কাছে মারা যান এক ব্যক্তি। কিন্তু সমুদ্রসৈকতে প্যারাশ্যুট থেকে এমন ঘটনা এ রাজ্যে প্রথম।কিন্তু তরুণবাবু প্যারাসেলিং করার জন্য অনড় ছিলেন। যে জিপের সাহায্যে প্যারাসেলিং করানো হচ্ছিল, তাতে বসেছিলেন তরুণবাবুর বাকি তিন বন্ধু। তাঁদেরই এক জন সুজয় পালের কথায়, ‘‘সমুদ্রের ধার দিয়ে যাচ্ছিল জিপটি। কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় হঠাৎই প্যারাশ্যুটের কাপড় ‘হাই মাস্ট’ ল্যাম্পপোস্টে আটকে যায়। হাওয়ার দাপটে প্যারাশ্যুটের কাপড় সমেত পোস্টে আটকে গিয়েছিল তরুণ। সেই সময় চালক জিপ জোরে চালিয়ে দিয়ে প্যারাশ্যুটের কাপড় খোলার চেষ্টা করে। আর সেই টানেই প্রায় ৫০ ফুট উপর থেকে পোস্ট সমেত নীচে পড়ে যায় তরুণ।’’ কাঁদতে কাঁদতে তরুণবাবুর আর এক বন্ধু অমৃত মণ্ডল বলেন, ‘‘তরুণ পোস্টের উপর থেকে আপ্রাণ চিৎকার করছিল। জিপ টান দিতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল পোস্টটা। কিছু করার সুযোগই পাইনি। নীচে আছড়ে পড়ার পরে ওর পিঠের হাড় বেরিয়ে এসেছিল!’’
১| তখনও আটকায়নি প্যারাশ্যুট ২| পোস্টে জড়িয়ে গিয়েছে প্যারাশ্যুট ৩| জিপের হ্যাঁচকা টানে হেলে পড়ছে পোস্টটি ৪| পোস্ট সমেত সৈকতে পড়ছেন তরুণবাবু | ছবি: তন্ময় দাস |
ক্ষমতায় আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতাকে লন্ডন, দার্জিলিংকে সুইৎজারল্যান্ড আর দিঘাকে গোয়া বানানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। তার পরেই দিঘায় সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হয়। আস্তে আস্তে দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের আওতায় আসে মন্দারমণি, তাজপুর। ইতিমধ্যে ২০১২-১৩ সাল নাগাদ মন্দারমণিতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে শুরু হয় প্যারাসেলিং-এর মতো ওয়াটার স্পোর্ট। কোনও প্রশিক্ষক ছাড়া সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে পরিষেবা দেওয়া, সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকা, সংস্থাগুলির লাইসেন্স না থাকা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে বহু বার। এর আগে দিঘায় স্নানে নেমে স্পিড বোটের ধাক্কায় জখম হয়েছিলেন এক পর্যটক। মন্দারমণির সৈকতে গাড়ি উল্টে মৃত্যু হয়েছিল দুই পর্যটকের। তার পরেও প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করে রমরমিয়ে ব্যবসা জারি রেখেছে সংস্থাগুলি।
এ দিনের দুর্ঘটনার পরেও দায় এড়িয়েছে সব পক্ষই। যে সংস্থার প্যারাসেলিং পরিষেবায় এ দিন দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই ‘বেঙ্গল স্পোর্টস’-এর কর্ণধার সত্যরঞ্জন খাটুয়া কাঁথির শাবাজপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য। তাঁর দাবি, ‘‘প্যারাসেলিং করাতে গেলে যে লাইসেন্স লাগে, আমার জানা নেই। তিন মাস ধরে রামনগর-২ পঞ্চায়েত সমিতির থেকে বছরে ৩০ হাজার টাকার বদলে অনুমতি পেয়ে আমি সংস্থা চালাই।’’ এ দিনের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এ দিন যিনি জিপ চালাচ্ছিলেন, তাঁর কাছে লাইসেন্স রয়েছে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।’’ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অরুণ দাস বলেন, ‘‘ওই সংস্থা আমাদের এলাকায় ব্যবসা করায় আমরা অনুদান নিই। এ ছাড়া কোনও অনুমতি দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই।’’
এ ভাবে দলের পঞ্চায়েত সদস্যের নাম জড়ানোয় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছেন জেলার তৃণমূল নেতৃত্ব। রামনগরের তৃণমূল বিধায়ক তথা দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য অখিল গিরি দলের ভূমিকার কথা মেনেও নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রশাসনের নিষেধ রয়েছে। রাজ্য সরকারও অনুমতি দেয়নি। তা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন ও আমাদের দলের কয়েক জন নেতার প্রশ্রয়ে এমন ঘটে চলেছে।’’ পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘পুলিশের মদতেই এমন বেআইনি কাজ চলছে। আমি বিষয়টি নিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলব। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে সকলকে গ্রেফতার করা হবে।’’ রাজ্য পর্যটন দফতর কী ভাবছে? পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু এ দিন ঘটনাটি শুনে বললেন, ‘‘কেউ প্যারাসেলিং করাতে চাইলে পর্যটন দফতরের কিছু বলার নেই। কিন্তু বিনা অনুমতিতে, উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া যাতে কেউ এ সব করতে না পারেন, সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।’’