জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে হলদিবাড়ি প্যাসেঞ্জার আটকে বিক্ষোভ বিজেপি কর্মীদের। নিজস্ব চিত্র।
বন্ধের দিন তাড়াতাড়ি অফিস পৌঁছতে চেয়েছিলেন। তাই অন্য দিনের থেকে কয়েক ঘণ্টা আগেই মছলন্দপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সরকারি কর্মী কৌশিক দত্ত। ভোর ৬টা নাগাদ স্টেশনে এসে ট্রেনও পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র দুটো স্টেশন পেরিয়ে অশোকনগরে বিজেপি কর্মীদের অবরোধে সেই ট্রেন গেল থমকে।ঘণ্টা চারেক বিভিন্ন স্টেশনে আটকে থাকার পর কৌশিকবাবু যখন দমদমে নেমে মেট্রোয় উঠলেন তখন প্রায় ১০টা বেজে গিয়েছে।
একই অভিজ্ঞতা লক্ষ্মীকান্তপুরের ব্রজমাধব নস্করের। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিলেন, তখন ভাল করে আলো ফোটেনি। কিন্তু, সেই সাতসকালেই বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের কেউ কেউ রেলের ওভারহেডের তারে কলাপাতা ফেলে দিয়েছিলেন। ফলে সাড়ে চারটে থেকেই ট্রেন চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ব্রজমাধববাবু শিয়ালদহ নেমেছেন বেলা সওয়া ৩টের সময়। কারণ, ওই শাখায় ট্রেন চলাচল শুরুই হয় বুধবার বেলা দেড়টা নাগাদ।এত ক্ষণ ট্রেনে আটকে থাকার পর যখন শিয়ালদহে নামেন ওই ব্যবসায়ী, তখন রীতিমতো বিধ্বস্ত। খাওয়াদাওয়া হয়নি ভাল করে। সঙ্গের জলও ফুরিয়ে গিয়েছে।
গোটা রাজ্যে ছবিটা মোটের উপর একই। হাওড়া এবং শিয়ালদহ ডিভিশনের প্রায় প্রতিটি শাখায় এ দিন ট্রেন অবরোধ করা হয়েছে। কোথাও ১০ মিনিট তো কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ দিন সকাল থেকে বিভিন্ন স্টেশনেই থমকে গিয়েছে ট্রেন। কোথাও ওভারহেডের তারে কলাপাতা, কোথাও বা রেললাইনের উপর বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের বসে পড়া— সব মিলিয়ে বিজেপির ডাকা বন্ধে সাতসকাল থেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব রেলের পরিষেবা। যার জেরে মহানগরমুখী মানুষজনের একটা বড় অংশ স্টেশন থেকেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। আর যাঁরা শেষমেশ পৌঁছলেন শহরে, তাঁদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত খারাপ। অন্য দিন যে পথ আসতে এক-দেড় ঘণ্টা লাগে, সে পথেই আজ কেউ কেউ এসেছেন চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে। একটা স্টেশনে অবরোধ উঠেছে, তো পরের স্টেশনে ফের অবরোধ হয়েছে। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবারও পরের স্টেশনে অবরোধ। এ ভাবেই সকাল থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে রেল পরিষেবা।
মেচেদা স্টেশনে অবরোধ তুলতে লাঠিচার্জ। নিজস্ব চিত্র।
কোথাও কোথাও দেখা গিয়েছে মাত্র পাঁচ-ছয় জন লোক লাইনের উপর দাঁড়িয়ে পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে রেল পরিষেবা। কোথাও দেখা গিয়েছে রেললাইনের উপর মাত্র একটা ঝান্ডা পোতা। আর তাতেই আটকে পড়েছে ট্রেন। এখানে কি রেলের কোনও দায় নেই? দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষের দাবি,‘‘আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়টি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। এমন অবরোধ হলে রেলের কিছু করার থাকে না। আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করতে পারি মাত্র। বাকিটা তাদের হাতে।’’কিন্তু, যাত্রীদের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে রেলের উপরেই। প্রায় আড়াই ঘণ্টা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্রেন পেয়েছিলেন অচ্যুৎ কুণ্ডু। বনগাঁ শাখার ওই নিত্যযাত্রীর অভিযোগ, ‘‘আমরা তো রেলকে ভাড়া দিই। তা হলে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে রেল নিজের দায়িত্ব এড়ায় কী করে?’’ অনেক যাত্রীর প্রশ্ন, রেলের হাতে তো আরপিএফ রয়েছে। তাদের দিয়ে অবরোধ তোলার চেষ্টা করা হয় না কেন? সঞ্জয়বাবু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘‘আরপিএফ রেলের সম্পত্তি দেখভাল করে। অবরোধ তোলা তাদের কাজ নয়।’’
বেহুলাতে রেল অবরোধে বিজেপি কর্মীরা। নিজস্ব চিত্র।
রেলের এই একই যুক্তি শোনা গিয়েছিল কয়েক দিন আগে। একটি জনজাতি সংগঠনের ডাকা রেল অবরোধের কর্মসূচিকে ঘিরে দক্ষিণ-পূর্ব রেল প্রায় ২১ ঘণ্টা কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া অবরোধ উঠেছিল রাত সাড়ে ৩টের সময়। যাত্রী ভোগান্তি চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছেছিল। খাবার, পানীয় জল, দূরপাল্লার ট্রেনে বিদ্যুৎ— কিছুই ছিল না। এ দিন যদিও অবরোধ তুলতে অতটা সময় লাগেনি। সঞ্জয়বাবুর কথায়: ‘‘কোনও জায়গাতেই ১০-১৫ মিনিটের বেশি অবরোধ হয়নি। সকাল ১০টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল অস্বাভাবিক ছিল অবরোধের কারণে।তার পর থেকেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।’’ তবে যাত্রী ভোগান্তির কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন তিনি। বলেন, ‘‘এক স্টেশনে অবরোধ ওঠার পর হয়তো পরের স্টেশনেই অবরোধ শুরু হয়েছে। আর তার ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, এ দিন সকালে দক্ষিণ-পূর্ব রেলে মোট ১৮টি লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। আরণ্যক এক্সপ্রেস ছাড়া বাকি সব মেল-এক্সপ্রেস ট্রেনই সময়মতো চলেছে। পুরুলিয়াগামী ওই ট্রেনটির যাত্রাপথ শালিমার থেকে সাঁতরাগাছিতেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: ‘আমার মরা ছেলেটাকেও ওরা ছাড়ছে না’
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবিকুমার মহাপাত্রও যাত্রী ভোগান্তির কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘সকাল ১০টা পর্যন্ত একের পর এক ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকে পড়ে। তার পর থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয়। তবে, বনগাঁ এবং লক্ষ্মীকান্তপুর শাখায় দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ট্রেন চালানো যায়নি।’’ তিনি জানান, পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনে মোট ৪০ জোড়া ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে। হাওড়া ডিভিশনে এ দিন বাতিল হয়েছে তিনটি ট্রেন।
আরও পড়ুন: ফের উত্তর দিনাজপুরে গুলিবিদ্ধ এক ছাত্র
রেলের যুক্তি শুনতে নারাজ যাত্রীরা। হুগলির কোন্নগরে এ দিন সকাল থেকে দীর্ঘ ক্ষণ অবরোধ হয়েছে। সেখানে আটকে পড়া যাত্রী নরেশ সিংহের কথায়: ‘‘শহরতলির একটা বড় অংশের সঙ্গে কলকাতা শহরের যোগাযোগ মূলত রেলপথের মাধ্যমেই। সকলেই সেটা জানেন। তা সত্ত্বেও রেল এ বিষয়ে উদাসীন থাকে কী করে ভেবে পাই না।’’
(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার খবর এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)