লম্বা একটা ঘরের দু’পাশে সারি দেওয়া ৭০ শয্যায় শুয়ে প্রায় দেড়শো রোগী। ঘরের মাঝখানে বসে মাত্র এক জন নার্স। সামান্য ত্রুটিতেই রোগীর পরিজন তাঁর উপরে চড়াও হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের যে-কোনও ওয়ার্ডের চেনা ছবি এটাই!
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, আকাল শুধু ডাক্তারের নয়। স্টাফ নার্সেরও সঙ্কট চলছে রাজ্য জুড়ে। সম্প্রতি ডিএইচএস (নার্সিং)-এর তরফে স্বাস্থ্য ভবনের শীর্ষ কর্তাদের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী রাজ্যে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার স্টাফ নার্স নেই। এর ফলে অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে মুখ থুবড়ে পড়ছে রোগী-পরিষেবা।
স্বাস্থ্য দফতর জানাচ্ছে, স্টাফ নার্সেরাই হাসপাতালে রোগীকে ‘বেড সাইড’ পরিষেবা দেন। অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীকে ওষুধ, ইঞ্জেকশন দেওয়ার দায়িত্ব স্টাফ নার্সের। তাঁদের উপরে থাকেন সিস্টার-ইন-চার্জ এবং নার্সিং সুপার। সরকারি হাসপাতালে ক’জন সিস্টার-ইন-চার্জ ও নার্সিং সুপার থাকবেন, সেটা স্থির হয় স্টাফ নার্সের অনুপাতে। তাই স্টাফ নার্সের ঘাটতি চলায় কমেছে সিস্টার-ইন-চার্জ এবং নার্সিং সুপারের সংখ্যাও।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সিস্টার-ইন-চার্জদের একাংশ জানাচ্ছেন, কর্মী কম বলে আলাদা ভাবে ওয়ার্ডের প্রত্যেক রোগীর খেয়াল রাখা যাচ্ছে না। যার জেরে তাঁদের সমস্যা অনেক সময়েই উপেক্ষিত হচ্ছে। নার্সের সংখ্যা কম হওয়ায় ছুটির ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে ক’জন নার্স রয়েছে, সেই অনুপাত দেখে কোনও নার্সের ছুটি মঞ্জুর করেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হাসপাতালে নার্সের সংখ্যা এতই কম যে, অধিকাংশ সময়ে তাঁদের ছুটি মঞ্জুর নিয়ে সমস্যা হয়। তাই চাপ বেশি থাকায় কাজের মানও কমছে বলে মনে করছেন নার্সদের একাংশ।
নার্স সংগঠন নার্সিং ইউনিটির সাধারণ সম্পাদিকা পার্বতী পাল বলেন, ‘‘রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নার্সেরা। কিন্তু অনেক সময়েই পরিকাঠামোগত এই ত্রুটি রোগীর পরিজনদের চোখে পড়ে না। তাঁরা ভাবেন, সামনে যিনি আছেন, তিনি ফাঁকি দিচ্ছেন। আমরা হেনস্থার মুখে পড়ছি। নার্স-ঘাটতি মেটানোর দাবিতে আমরা মিছিল করব। ডেপুটেশন দেব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।’’
স্বাস্থ্য ভবনের নার্সিং শাখার একাংশ জানাচ্ছেন, পদোন্নতির সূত্রে কিছু স্টাফ নার্স হয়ে সিস্টার-ইন-চার্জ হলে সঙ্কট বাড়বে। তাই অধিকাংশ জায়গায় নার্সদের প্রোমোশন আটকে থাকছে। ডিএইচএস (নার্সিং)-এর এক কর্তার কথায়, ‘‘কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোই হিমশিম খাচ্ছে। জেলা হাসপাতালের অবস্থা আরও শোচনীয়। জেলার হাসপাতালে পরিদর্শন গেলেই কর্মী বাড়ানোর দাবি জানান নার্সেরা।’’
স্বাস্থ্য ভবনের এক শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, রাজ্যে মোট কত নার্স রয়েছেন এবং কতটা ঘাটতি, সেটাই দীর্ঘদিন দেখা হয়নি। তাই হিসেব করতে বসে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ‘‘আপাতত সাড়ে ছ’হাজার ঘাটতির হিসেব পাওয়া গিয়েছে। কী ভাবে এই সমস্যা মেটানো যায়, সেটা দেখা হচ্ছে,’’ বলেন ওই স্বাস্থ্যকর্তা।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানান, সরকারি হাসপাতালে এখন একাধিক নতুন বিভাগ শুরু হচ্ছে। তাই নার্সের চাহিদাও বাড়ছে। সেই সমস্যা মেটাতে স্বাস্থ্য দফতর উদ্যোগী হয়েছে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে। বিএসসি নার্সিংয়ে আসন বা়ড়ানোর বিষয়টিও ভেবে দেখা হচ্ছে।
‘‘রাজ্য সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজছে। সেই কাজে নার্সদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই কী ভাবে প্রশিক্ষিত যোগ্যতাসম্পন্ন আরও বেশি স্টাফ নার্স নিয়োগ করা যায়, সে-দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে,’’ বলেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা।