বিয়ে রুখে হুমকির মুখে দুই নাবালিকা

মায়ের মুখের উপরেই দুই বোন জানিয়ে দিয়েছিল, ‘এখনই বিয়ে নয়। আরও পড়তে চাই।’ ভেস্তে গিয়েছিল বিয়ে। কিন্তু পাত্র ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা বিষয়টা হজম করতে পারেনি। দুই কিশোরীকে প্রায়ই হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। যদিও তারা কোথাও তা লিখিত ভাবে জানায়নি। বাড়িতেও বাধা কম ছিল না। বিয়ে করতে নারাজ চোদ্দো আর পনেরোর দুই মেয়েকে আটকে রেখেছিলেন মা।

Advertisement

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

বেলডাঙা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০৪:০৯
Share:

মায়ের মুখের উপরেই দুই বোন জানিয়ে দিয়েছিল, ‘এখনই বিয়ে নয়। আরও পড়তে চাই।’

Advertisement

ভেস্তে গিয়েছিল বিয়ে। কিন্তু পাত্র ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা বিষয়টা হজম করতে পারেনি। দুই কিশোরীকে প্রায়ই হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। যদিও তারা কোথাও তা লিখিত ভাবে জানায়নি। বাড়িতেও বাধা কম ছিল না। বিয়ে করতে নারাজ চোদ্দো আর পনেরোর দুই মেয়েকে আটকে রেখেছিলেন মা। দরজার আগল ভেঙে তারা থানায় হাজির হয়। বিয়ে বন্ধ করিয়ে দেয় পুলিশ।

কিন্তু তাতে বিপত্তি কমেনি।

Advertisement

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বেনাদহ গ্রামের মেরিনা ও গোলাপি খাতুন এখন ঘরে-বাইরে কটূক্তির মুখে পড়ছে। মাকে থানায় টেনে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে অনেক আত্মীয়ই তাদের উপরে অখুশি। তবে বেশি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছএ পাত্রপক্ষের শাসানিই। মেয়েদের না জানিয়েই ২৬ মে তাদের বিয়ে ঠিক করেছিলেন মা মমতাজ বিবি। দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার সময় সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেরিনা ও নবম শ্রেণির গোলাপি জানায়, তারা পড়াশোনা করতে চায়। পরিস্থিতি সামলাতে মেয়েদের আটকে রাখেন মমতাজ।

এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যে যুক্তি দেওয়া হয়, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। মমতাজ জানান, স্বামী, দুই ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর অভাবের সংসার। স্বামী ও এক ছেলে প্রতিবন্ধী। তিনিই বিড়ি বেঁধে কোনও রকমে সংসার চালান। গ্রামের দু’জন বিনা পণে বিয়ে করবে শুনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। মেরিনা আর গোলাপি অবশ্য বলছে, ‘‘মা হয়তো ভাবছে, বিয়ে দিলে ঝামেলা শেষ। সংসারে অভাব কমবে। কিন্তু সবটাই এত সোজা নয়। আমাদের চেনা একটি মেয়ের ১৩ বছরে বিয়ে হয়েছিল। পরে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়।’’ স্কুলেও তারা শুনেছে, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দিতে নেই। দুই বোন নিশ্চিত, ‘‘এখন মা রাগ করছে। কিন্তু আমরা দু’জনেই যখন লেখাপড়া শিখে সংসারের হাল ধরব, তখন মা-ই সবচেয়ে খুশি হবে।’’

তবে বাইরে থেকে যে শাসানি আসছে, তার মোকাবিলা কী করলে করতে হয় তা দুই বোন জানে না। তাদের কথায়, ‘‘আমাদের সঙ্গে কথা বলে তো কেউ বিয়ে ঠিক করেনি। তবে বিয়ে ভাঙার রাগ ওরা আমাদের উপরে দেখাচ্ছে কেন? কেন আমরা ওদের ভয়ে বাইরে বেরোতে পারব না?’’ মমতাজ বিবি বলেন, ‘‘গ্রামেরই কেউ কেউ হুমকি দেওয়ায় বিপদের কথা ভেবে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরোতে দিচ্ছি না।’’ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা অবশ্য এ সব কথায় আমলই দিতে রাজি নয়।

বিষয়টি নিয়ে গোড়া থেকে তৎপর জেলার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে আমাদের আর্জি, যারা হুমকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’’ বেলডাঙা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সিপিএমের আবু সৈয়দ ও বেলডাঙা ১ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি বনতোষ ঘোষেরা জানান, হুমকির বিষয়ে তাঁরাও পুলিশের সঙ্গে কথা বলবেন। বহরমপুরের মহকুমাশাসক সুপ্রিয় দাস বলেন, ‘‘পুলিশকে বলছি, দু’টি মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে।’’ বেলডাঙার ওসি অরূপ রায় বলেন, ‘‘ওদের যাতে কোনও বিপদ না হয়, সে দিকে নজর রাখছি।’’

মমতাজ এখন বলছেন, মেয়েরা নিরাপদে থাকলে তারা পড়তে চাইলে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো খরচ চালাতে পারব না। সরকার যদি সাহায্য করে, তবেই পড়তে পারে।’’ বেলডাঙা ব্লক সমাজকল্যাণ আধিকারিক দিবাকর প্রামাণিকের আশ্বাস, ‘‘ওদের পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি। যাতে কোনও রকম সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারে আমরা খেয়াল রাখব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন