দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে আজ, শুক্রবার বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসব। গত অর্ধশতাব্দী, প্রতিটি সমাবর্তন উৎসবের আমি সাক্ষী।
আগের আমলে তো শান্তিনিকেতনে পৌষের মেলা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন একই সঙ্গে হত। আমি যখন আশ্রমের কাজে যোগ দিই, তখন বিশ্বভারতীর আচার্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। বিশ্বভারতীর সংবিধানে এমন কোনও বিধান নেই যে, পদাধিকার বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেই বিশ্বভারতীর আচার্য হতে হবে। যদিও, এক-আধবার বাদে বরাবরই আমাদের প্রধানমন্ত্রীরাই বিশ্বভারতীর আচার্য হয়ে এসেছেন। যদি কোনও প্রধানমন্ত্রী অনিচ্ছুক হন, তিনি বিশ্বভারতীর দায়িত্বভার গ্রহণের প্রস্তাবে সম্মত না-ও হতে পারেন। তবে ‘গুরুদেব’-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রধানমন্ত্রী চাইবেন আচার্য না হতে?
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে আমরা বিশ্বভারতীর আচার্য রূপে পেয়েছিলাম অনেকগুলি বছর। নেহরুর পরে আচার্য রূপে এসেছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তখন সুধীরঞ্জন দাস উপাচার্য। তার পরে নতুন উপাচার্য হলেন কালিদাস ভট্টাচার্য আর নতুন আচার্য হন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী, ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। সেই বছরেই আমি শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক পদে যোগ দিই। আমি আসার পরেও বেশ কয়েক বছর মেলা ও সমাবর্তন এক সঙ্গে হয়েছিল। তখনও শান্তিনিকেতনে হেলিকপ্টার যুগ শুরু হয়নি। জওহরলাল, লালবাহাদুর, ইন্দিরা গাঁধী দিল্লি থেকে প্লেনে পানাগড়ে এসে নামতেন। সেখান থেকে হুডখোলা গাড়িতে বোলপুর। পথের দু’পাশে কৌতূহলী লোকের ভিড় দেখলে সিট থেকে দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করতেন। হাত নাড়তেন।
সে সময় ৮ পৌষের বড় আকর্ষণ ছিল দু’টি। সন্ধ্যায় আতসবাজি, আর সকালে সমাবর্তন উৎসবের মঞ্চে ইন্দিরা-দর্শন। আজও আম্রকুঞ্জে সুসজ্জিত ম্যারাপ বাঁধা হয়। মঞ্চে ঢোকার পথটি, যে পথ দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে মঞ্চে ওঠার ব্যবস্থা, সেই সেখানে মাটি লেপে মসৃণ করে তার পরে শুকোলে কলাভবনের ছেলেমেয়েরা দিন তিনেক ধরে বসে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যের আলপনায় রঙিন কার্পেট বানিয়ে ফেলত। কর্মসচিব, আচার্য, উপাচার্য, ফ্যাকাল্টির অধ্যক্ষরা, কর্মসমিতির সদস্যরা— এই সব ভিআইপিরা দু’টি সারিতে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসতেন। তার পরে মঞ্চে উঠতেন কর্মসচিব, আচার্য, উপাচার্য এবং সমাবর্তন-ভাষণ যিনি দেবেন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
এক বার একটা ঘটনা ঘটেছিল মনে পড়ছে। মঞ্চে উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্য ও আচার্য ইন্দিরা গাঁধী উপবিষ্ট। বেদমন্ত্র উচ্চারিত হয়ে গিয়েছে। সমাবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছে আধ ঘণ্টা হল। এমন সময় হঠাৎ আম্রকুঞ্জের মধ্যে বিকট আওয়াজে একটা বোমা ফাটল মঞ্চ কাঁপিয়ে, সমবেত সকলের বুকে হৃদকম্প তুলে। আমাদের বসার আসন থেকে বোমার ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে। উপরের দিকে উঠে সেই ধোঁয়াটা ছড়িয়ে যাচ্ছে আমগাছগুলোর উপর দিয়ে। মুহূর্তের জন্য সবাই হতবাক, বিস্মিত। এমন ঘটনা সত্যিই শান্তিনিকেতনে ভয়ঙ্কর অপ্রত্যাশিত। সবাই দাঁড়িয়ে উঠেছে। ইন্দিরা শুধু তাঁর আসনে স্থির হয়ে বসে। কালিদাসদা মঞ্চের সামনে উঠে এসে মাইকটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে খুবই উত্তেজিত অবস্থায় চিৎকার করে বললেন— ‘আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। অনুগ্রহ করে বসুন। আমাদের সভার কাজ যেমন চলছে চলবে। একটা বোমায় আমাদের কেউ বিচলিত করতে পারবে না।’ সৌভাগ্য, সে দিন আর দ্বিতীয় বোমা বিস্ফোরিত হয়নি। সমাবর্তন শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ হয়েছিল।
সম্ভবত এর পরের বছরেই ঠিক হল প্রধানমন্ত্রী আসবেন হেলিকপ্টারে। মেলার মাঠেরই এক প্রান্তে, ছেলেদের হস্টেলের দিকে হেলিপ্যাড তৈরি হল। আর পানাগড় থেকে নয়, সোজা হেলিকপ্টার এসে নামবে পূর্বপল্লির মেলার মাঠে। ৮ পৌষের সকাল। শীতকাল। নীল আকাশ। ওই দূর থেকে দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টার আসছে আকাশে ভেসে। শান্তিনিকেতনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে কি উৎসাহ উদ্দীপনা! নাগরদোলা সেখানে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে। হেলিপ্যাডে আচার্যকে বরণ করার জন্য ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত। দূরে বেশ কয়েক’টি সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে। তারই একটিতে প্রধানমন্ত্রী উঠে প্রথমে উত্তরায়ণে আসবেন। উদয়নে দশ মিনিটের বিশ্রাম।
সেই হেলিকপ্টার যখন আকাশ থেকে অনেক নীচে নেমে এসে প্রায় মাটি ছোঁবে— তার সেই লম্বা পাখার ঘূর্ণিতে মেলার ‘মাথা’ গেল ঘুরে। ছোট ছোট প্রায় সব দোকানের ছাউনি তীব্র বাতাসের ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে উড়ে গেল ভেদিয়া থেকে প্রান্তিক স্টেশন পর্যন্ত। সে এক কাণ্ড! পরের বার থেকে আশ্রমের ভিতরে ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠে হেলিপ্যাডের ব্যবস্থা হল। এবং তার পর থেকেই মনে হয় মেলার সময়ে
সমাবর্তন উৎসবের চিরাচরিত প্রথারও পরিবর্তন ঘটল।
ইন্দিরা গাঁধী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তখন কোনও পুলিশ চোখে পড়ত না। জনা পঞ্চাশেক মানুষ গোল হয়ে ঘিরে এই অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। ভিড় নেই, বন্দুক নেই, বাঁধাবাঁধি নেই। কোনও এক সমাবর্তনে এসে ইন্দিরা একাই নির্জন দুপুরে কাউকে কিছু না বলে মাস্টারমশাই বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। সেই কালটাকে চোখের সামনে দেখেছি।
আমাদের আশ্রমের সমাবর্তনের পরিবর্তন ঘটেছে মূলত দিল্লির কারণে। সময় পাল্টেছে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। সমাবর্তনের দু’দিন আগে থেকে গোটা শান্তিনিকেতনটা যেন পুলিশের হাতের মুঠোয় চলে যায়। ফলে পুরাতন শান্তিনিকেতনের খোলামেলা সমাবর্তনের সেই পরিবেশটা এ কালে অনেকটাই আড়ষ্ট হতে বাধ্য হয়েছে। গত পঞ্চাশ বছরে প্রায় সব প্রধানমন্ত্রীকেই সমাবর্তনের মঞ্চে দেখেছি। এক বার আমি কর্মসমিতির সদস্য হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, আচার্য অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে দুপুরে উত্তরায়ণে লাঞ্চও করেছিলাম। বাজপেয়ীজি সে দিন খুব প্রফুল্ল মেজাজে ছিলেন।
আচার্য হিসেবে নরসিমা রাও একবার এসেছিলেন। উদয়নের ভিতরের হলঘরে তাঁর একটা ছোট বক্তৃতার আয়োজন হয়েছিল আমন্ত্রিত শ্রোতাদের সামনে। বক্তৃতার শেষে তিনি যেই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছেন, তার পরক্ষণেই তিনি যেখানে বসেছিলেন তার মাথার উপরের ফ্যানের ব্লেডটা খুলে গিয়ে দেওয়ালে ছিটকে লাগল। ভাগ্যিস তিনি ঘর থেকে সেই মুহূর্তে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সে দিন খুব বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। এখন আর আচার্যরা ছাত্রছাত্রীদের হাতে ছাতিম পাতা দিতে সময় পান না। জওহরলাল থেকে রাজীব গাঁধী— সমাবর্তনের পরে উত্তরায়ণে কত ছাত্রছাত্রীই না আচার্যদের গা ঘেঁষে দলবদ্ধ ছবি তুলেছে। একটা সময় তো ছিল, যখন সমাবর্তনে শান্তিনিকেতনে এসে আচার্যরা ভুলে যেতেন তাঁরা প্রধানমন্ত্রী।