• শ্যামবাজারের বাসিন্দা নীল বছর দুয়েক আগে বিউটিশিয়ানের কাজ শিখে উত্তরপাড়ার একটি পার্লারে কাজ করতে ঢোকেন। কিন্তু মাসখানেক পরেই সেই কাজ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। নিয়োগকর্তাদের বক্তব্য ছিল, তাঁর কাছে পরিষেবা নিতে চাইছিলেন না কেউ। তার পরে আর কোনও কাজ পাননি নীল।
কারণ? তিনি ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিত।
• কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া বিউটিশিয়ান কোর্সের প্রশিক্ষক সংস্থা দক্ষ বিউটিশিয়ানের শংসাপত্র দিয়েছে ‘ঋ’কে। কিন্তু বড় কোনও সংস্থায় তাঁর কাজ জোটেনি। বছরখানেক ধরে দমদমের একটি ছোট পার্লারেই পড়ে আছেন তিনি।
কারণ? তিনিও ট্রান্সজেন্ডার।
ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরা এখনও আমজনতার কাছে কতটা ব্রাত্য, তাঁরা সেটা পদে পদে টের পাচ্ছেন বলে জানান নীল আর ঋ। অথচ দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৪ সালে তাঁদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি ও অধিকার দিয়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাঙ্গনে সেই অধিকার এখনও পুরোপুরি কায়েম করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ। অভিযোগ, তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়েও কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। ওই লিঙ্গের অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে যাঁরা লেখাপড়া বা প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি, তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ। রাজ্য সরকার দে়ড় বছর আগে তাঁদের জন্য উন্নয়নমূলক বোর্ড গড়লেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অনেকে সেই অসন্তোষ নিয়ে মুখ খুলেছেন।
রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এই নিয়ে উদাসীনতার অভিযোগ ভূরি ভূরি। এরই মধ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা’য় এ রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডারদের উন্নয়নে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও কাজের সুযোগ দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে কয়েকটি সংস্থা। তাতে সাড়া দিয়েছে ‘কলকাতা রিস্তা’ নামে রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডারদের একটি সংগঠন। তাদের কাছে নানান প্রশিক্ষণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনায়।
কী ভাবে চলবে এই প্রশিক্ষণ?
প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা সর্বভারতীয় একটি সংস্থা সূত্রের খবর, ওই যোজনায় ৪০টি কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাউন্সিলের অধীনে বিভিন্ন সংস্থা পিছিয়ে পড়া ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়ে, এমনকী অ্যাসিড-আক্রান্তদের পর্যটন, হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, বিউটি অ্যান্ড ওয়েলনেসের মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে। এই প্রশিক্ষণ দিতে ১১০০টি সংস্থা এগিয়ে এসেছে।
শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই কাজ সারতে রাজি নয় কেন্দ্র। তাই কাজের ক্ষেত্রেও সাহায্য করা হবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া হবে চাকরি। এই বিষয়ে এগিয়ে এসেছে ৫৫টি শিল্প সংস্থা। সত্যিই কি প্রশিক্ষণের পরে কাজের সুযোগ পাবেন তৃতীয় লিঙ্গের লোকেরা? কলকাতার ভিআইপি রোডে হয়ে এক কর্মশালায় উঠল সেই প্রশ্নও। প্রশ্নটা উঠছে, কারণ, এ রাজ্যে ওঁদের জন্য তৈরি উন্নয়ন বোর্ড এখনও কোনও কাজই করে উঠতে পারেনি!
এই প্রশ্নের জবাবে একটি কাউন্সিলের চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার (সিইও) অনু ওয়াধা-র আশ্বাস, ‘‘এই যোজনায় শুধু প্রশিক্ষণ নয়। কাজ দেওয়ার কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কোন কোন শিল্প সংস্থা ওঁদের নিয়োগ করবে, তারা আগে থেকেই কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তাদের প্রতিনিধিরা নিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।’’ তাই রাজ্য সরকারের গড়া বোর্ড কাজ না-করলেও তৃতীয় লিঙ্গের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে ‘কলকাতা রিস্তা’।
প্রধানমন্ত্রীর এই যোজনাকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্যা রঞ্জিতা। বোর্ডটি আছে রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের অধীনে। কাজ না-হওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ওই দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা। তাঁর দাবি, ‘‘বোর্ড নিজেদের মতো কাজ করে চলেছে। কী কাজ করছে, তা জানতে হলে পরে আসুন। এখন তা ব্যাখ্যা করতে পারব না।’’
মন্ত্রী ব্যাখ্যা না-দিলেও তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন এবং তাঁদের পাশে দাঁড়ানো বিভিন্ন সংস্থার কটাক্ষ, রাজ্য সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত কাজ দেওয়া বলতে তো শুধু একটি কলেজের অধ্যক্ষার পদে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়োগ! এর বাইরে সরকারি উদ্যোগে ট্রান্সজেন্ডারদের কর্মসংস্থানের দৃষ্টান্ত অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও খুঁজে পাওয়া ভার!!