ওষুধ সংস্থাদের সঙ্গে বৈঠক

‘ঝলমলে’ স্বাস্থ্যে লগ্নি টানতে মাঠে রাজ্য

সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির স্রোতে কিছুটা ভাটার টান। পুঁজি আকর্ষণে তাই শিল্পের পাশাপাশি স্বাস্থ্যক্ষেত্রকেও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সামনে জোরালো ভাবে তুলে ধরতে চাইছে রাজ্য সরকার। জানুয়ারির শিল্প সম্মেলনের মুখে এই লক্ষ্যে নবান্ন রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৫
Share:

সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির স্রোতে কিছুটা ভাটার টান। পুঁজি আকর্ষণে তাই শিল্পের পাশাপাশি স্বাস্থ্যক্ষেত্রকেও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সামনে জোরালো ভাবে তুলে ধরতে চাইছে রাজ্য সরকার। জানুয়ারির শিল্প সম্মেলনের মুখে এই লক্ষ্যে নবান্ন রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছে।

Advertisement

প্রশাসনের কর্তাদের মতে, বর্তমান আমলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো ভাল ‘পারফরম্যান্স’ করেছে পশ্চিমবঙ্গ। ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় সব পরিষেবাদানের মমতা-নীতি সারা দেশে তারিফ কুড়িয়েছে। গত ক’বছরে একাধিক এসএনসিইউ, আইটিইউ হয়েছে, আরও হতে চলেছে। সরকারি দাবি: সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে যত মাল্টি স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ও সরকারি মেডিক্যাল কলেজ খুলেছে বা খোলার অপেক্ষায়, তা আগে দেখা যায়নি।

এ হেন ‘সাফল্য ও সম্ভাবনা’য় উজ্জ্বল স্বাস্থ্যক্ষেত্রই এ বার সরকারের লগ্নি টানার বড় বাজি। যে উদ্দেশ্য সাধনের তাগিদে স্বাস্থ্যকর্তাদের নামানো হয়েছে। কী রকম?

Advertisement

নবান্নের শীর্ষ মহলের নির্দেশে ২৯ নভেম্বর স্বাস্থ্যভবনে অন্তত ৮০টি ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী প্রস্তুতকারী দেশি-বিদেশি সংস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্য-আধিকারিকেরা বৈঠক করেছেন। স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব রাজেন্দ্র শুক্ল, সচিব বিনোদকুমার ও রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর কমলাকান্তও সেখানে ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের উপযোগিতা সম্পর্কে সংস্থাগুলিকে তাঁরা অবহিত করেছেন। রাজেন্দ্রবাবুর কথায়, ‘‘বিভিন্ন ফার্মা কোম্পানির কাছে পশ্চিমবঙ্গ সোনার খনি হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এ রাজ্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্য-সরঞ্জামের বাজার বাড়ছে। তাই সরকার চায়, ওরা এখানে কারখানা নিয়ে আসুক।’’

‘সোনার খনি’ কেন, তা ব্যাখ্যা করেছেন সচিব বিনোদকুমার। ওঁর যুক্তি, ‘‘হাসপাতালে পরিষেবা ফ্রি হওয়ার পরে একা সরকারই বাজার থেকে বছরে অন্তত আটশো কোটি টাকার ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী কিনছে। অঙ্কটা দিন দিন বাড়বে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্রেতাও রয়েছে।’’

রাজ্যে ব্যবসার সম্ভাবনার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যভবন বৈঠকে এ-ও জানিয়েছে, এখানে স্যালাইনের বিপুল চাহিদা। অথচ আপাতত পশ্চিমবঙ্গে স্যালাইন তৈরি করে শুধু ইসলামপুরের এক কোম্পানি। দ্বিতীয় কারখানাটি হচ্ছে বেহালায়। ওষুধের কারখানা হাতে গোনা। অনেক সংস্থা বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে প্যাকেজিং করে বিক্রি করে। তারা পশ্চিমবঙ্গে প্যাকেজিং ইউনিট খুললে তাদের যেমন সুবিধে, তেমন এখানেও বিদেশি ওষুধের দাম কিছুটা কমতে পারে বলে সরকার মনে করছে।

রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই বিশাল বাজারেরই হাল-হদিস সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের সামনে তুলে ধরেছেন কর্তারা। জমি সংক্রান্ত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। ‘‘আমরা দেখব, ওঁদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয়। বাজারদরে জমি মিলবে। লাইসেন্স, বিদ্যুৎ, জল, দূষণ-দমকলের ছাড়পত্র ইত্যাদি চটজলদি এক জায়গা থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’’— ঘোষণা রাজেন্দ্রবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘চলতি মাসে ওদের সঙ্গে আবার বৈঠক হবে। সে দিন ওরা লিখিত ভাবে প্রস্তাব পেশ করবে। তা নিয়ে জানুয়ারির শিল্প সম্মেলনে আলোচনা হবে।’’

কিন্তু কারখানা করার মতো জমি মিলবে তো? বৈঠকে রাজ্যের তরফে জানানো হয়েছে, বারুইপুর ও দুর্গাপুরে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারখানা তৈরির জমি মজুত। উপরন্তু ডাবগ্রামের ৮৬ একরে নির্মীয়মাণ হেল্‌থ ট্যুরিজম হাবেও বিস্তর বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

ঘটনা হল, রাজ্যে আরও বেশি ওষুধ কারখানা গড়ে উঠলে লগ্নি ছাড়াও অন্য লাভের দিশা দেখছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। ওঁদের বক্তব্য— এখন সরকারি হাসপাতালে ওষুধ বা চিকিৎসা-সরঞ্জাম সরবরাহ নিয়ে স্বাস্থ্যভবনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বিভিন্ন সংস্থার অধিকাংশেরই কারখানা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। সেখান থেকে লরিতে মাল আনতে অনেক খরচ হয়। তাতে ওষুধের দাম বেড়ে যায়। সরবরাহে টান পড়লে হাসপাতালে ওষুধ-সঙ্কট দেখা দেয়। ‘‘রাজ্যে কারখানা হলে এই সমস্যাগুলো তো মিটবেই, পণ্যের মানের উপরে সরকারি নজরদারিও সহজ হবে।’’— মন্তব্য এক আধিকারিকের।

সরকার না হয় উৎসাহী। যাদের উৎসাহিত করতে এত আয়োজন, তারা কী বলছে? সে দিনের বৈঠকের পরে স্বাস্থ্যকর্তারা যতটা আশাবাদী, কিছু সংস্থার প্রতিক্রিয়া ততটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। বরং বেশ কিছু সংশয় তাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার নিরসন এখনও হয়নি। যেমন ইন্ডিয়ান ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান দীপনাথ রায়চৌধুরীর প্রশ্ন— ‘‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব রাজ্য, উত্তরাঞ্চল, জম্মু-কাশ্মীর বা হিমাচল করের উপরে আমাদের নানা ছাড় দেয়। পশ্চিমবঙ্গ দেবে? জমি কিনলে ভর্তুকি মিলবে?’’ গুজরাত, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানার মতো ওষুধ-শিল্পের পরিকাঠামো পশ্চিমবঙ্গ জোগাতে পারবে কিনা, বিভিন্ন সংস্থার তা-ও জিজ্ঞাস্য।

স্বাস্থ্যকর্তারা এ সব নিয়ে কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি। তাঁরা তাকিয়ে রয়েছেন পরবর্তী বৈঠকের দিকে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যভবনের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার যে ‘ঝলমলে’ চেহারা তুলে ধরা হচ্ছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত?

বস্তুত স্বাস্থ্য প্রশাসনেরই একাংশের পর্যবেক্ষণ, ছবিটা ঠিক এতটা উজ্জ্বল নয়। এই মহলের দাবি, নিত্য-নতুন মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ খুলতে গিয়ে লোকাভাবে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ‘ফ্রি’ ওষুধের জোগান নিয়েও বিস্তর টানাপড়েন। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ: যে সংস্থা সবচেয়ে কম দর দিচ্ছে, সরকার তাদেরই থেকে ওষুধ কিনছে, গুণমানের তোয়াক্কা না করে!

বিনিয়োগের পথে হাঁটার আগে এ সবও তারা মাথায় রাখবে বলে জানিয়েছে কোনও কোনও সংস্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন