স্কুলে বিনামূল্যে বই জোগায় রাজ্য সরকারই। তা সত্ত্বেও হরেক কিসিমের পাঠ্যপুস্তক চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্কুলের সঙ্গে বহু প্রকাশনা সংস্থার আঁতাঁতের অভিযোগ ওঠে আকছার। প্রাথমিক তদন্তে দীর্ঘদিনের সেই অভিযোগের আংশিক সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পরে অসুখ সারাতে দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করল সরকার।
কী সেই দাওয়াই?
রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতর বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিল, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সরকারি বই ছাড়া কোনও বেসরকারি প্রকাশকের বই ক্লাসঘরে পড়ানো যাবে না। প্রতিটি স্কুলে এ দিনই ওই নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার থেকে ওই নির্দেশ বলবৎ করতে বলা হয়েছে স্কুলগুলিকে।
স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানান, কোনও কোনও স্কুলের কারও কারও সঙ্গে কিছু বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার অলিখিত চুক্তি আছে। নিজেদের বই চালিয়ে দিলে কমিশন দেয় বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থা। তার চাপ গিয়ে পড়ে সাধারণ পড়ুয়াদের উপরে। স্কুলের পক্ষ থেকে বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার বই কেনার জন্য ছাত্রছাত্রীদের চাপ দেওয়া হয়। ফল ভুগতে হয় পড়ুয়াদের পরিবারকেই। ‘‘প্রকাশনা সংস্থা ও স্কুলের অনৈতিক আঁতাঁত ভাঙতেই আমাদের এই পদক্ষেপ,’’ বলেন ওই শিক্ষাকর্তা।
স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, পড়ুয়াদের স্বার্থে সব পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। তা সত্ত্বেও দেখা গিয়েছে, স্কুলের তৈরি ‘বুক লিস্ট’-এ পর্ষদের বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার বইয়ের নাম থাকে। যা থাকার কথা নয়। এমনকী অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ক্লাসে গিয়ে পড়ুয়াদের বিশেষ কিছু প্রকাশনা সংস্থার বই কেনার পরামর্শও দেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলো সেই সব বই কিনতে গিয়ে বাড়তি চাপে পড়ে যায়।
স্কুলশিক্ষা দফতরের পর্যবেক্ষণ, যে-উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে বই দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, স্কুল ও বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার এই ধরনের আঁতাঁতের ফলে সেটা ধাক্কা খাচ্ছে। ‘‘সরকারের বই পড়েই থাকছে। অন্য দিকে স্কুলের তরফে পড়ুয়াদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ সংস্থার বই না-আনলে ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এটা অনুচিত,’’ বলছেন শিক্ষাকর্তারা।
বেশ কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা অবশ্য স্কুলশিক্ষা দফতরের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, ভাল ফল করতে হলে অনেক পড়ুয়াই সরকারি বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার বইয়ের সাহায্য নেয়। সে-ক্ষেত্রে এই ফতোয়া ওই পড়ুয়াদের ক্ষতি করবে। ‘‘ইচ্ছে হলে কেউ অন্যান্য সংস্থার বই পড়তেই পারে। কিন্তু জোর করে সেগুলো চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটা অবশ্যই চাপের,’’ বলছেন স্কুলশিক্ষা দফতরের পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার।
স্কুলের বুক লিস্টে কোনও বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার বইয়ের নাম রাখা চলবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে স্কুলশিক্ষা দফতর। এই নির্দেশিকাকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সামিল মনে করছেন শিক্ষক সংগঠনের কেউ কেউ। বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘কোনও শিক্ষক মনে করতেই পারেন, ক্লাসে অন্য কোনও বইয়ের তথ্যকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা দরকার। তা যদি করতে দেওয়া না-হয়, সেটা হবে সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ।’’
কোনও কোনও শিক্ষকের প্রশ্ন, স্কুলশিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়। রেফারেন্স বইয়ের প্রয়োজন হয় মূলত নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদেরই। তারাই বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার বই ব্যবহার করে। তা হলে স্কুলে শুধু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত বই নিষিদ্ধ করা হচ্ছে কেন?
স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, শিক্ষার অধিকার আইনে বলা আছে, ছয় থেকে চোদ্দো বছরের পড়ুয়াদের সব বই বিনামূল্যে দিতে হবে। সে-ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার বই ব্যবহার না-করার নির্দেশ দেওয়াই যায়। কিন্তু নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বইগুলি বিনামূল্যে দেওয়ার কোনও নির্দেশ নেই। রাজ্য সরকার নিজেদের ইচ্ছেয় নবম থেকে দশম শ্রেণির কিছু বই বিনামূল্যে দেয়। তাই সে-ক্ষেত্রে পুরোপুরি বেসরকারি বই নিষিদ্ধ করা যাবে না।