জখম: মারের চোটে চোয়াল ভেঙে যাওয়ায় মনিরুলের দাঁতে লাগানো হয়েছে ট্রাকশন। ছবি: সজল কুমার চট্টোপাধ্যায়।
পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনা করতে গিয়েছিলেন দেগঙ্গার রামনগর প্রাথমিক স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক মনিরুল ইসলাম। তাঁকে মাটিতে ফেলে মারধর করা হয়। মাথায় পড়ে দশটি সেলাই। ভাঙে চোয়াল। মুখের ভিতরে ট্রাকশন লাগিয়ে পড়ে আছেন বাড়িতে। চিকিৎসা চালাতে গিয়ে শেষ হয়েছে সঞ্চয়। অভিযোগ, সব জানিয়ে বারবার প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘোরা সত্ত্বেও সাহায্য তো দূরের কথা, খোঁজ নিতেও এগিয়ে আসেনি কেউ।
এখন দেগঙ্গার চাঁপাতলার বাড়িতে শয্যাশায়ী মনিরুল। ‘‘হাসপাতাল থেকে ফিরে এই অবস্থাতেই যাই জেলাশাসকের কাছে। সেখানে লিখিত আবেদন করার পরে ফের পঞ্চায়েত নির্বাচন বিভাগে জানাতে বলা হয়। সেখানেও জানাই। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি,’’ খেদের সঙ্গে বললেন প্রহৃত শিক্ষক।
মঙ্গলবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চোয়াল ভেঙে যাওয়ায় মনিরুলের মুখে ট্রাকশন লাগানো হয়েছে। ভাল ভাবে কথা বলতে পারছেন না। তরল খাবার মুখে ঢেলে দিতে হচ্ছে। মনিরুল জানান, তৃতীয় পোলিং অফিসার হিসেবে রাজারহাটের নবীনচন্দ্র প্রাথমিক স্কুলে ভোট পরিচালনা করছিলেন তিনি। দুপুর পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। ১২টা নাগাদ মুখ ঢাকা ৮-১০ জন যুবক বোমাবাজি শুরু করে। ভয়ে অনেকে পালিয়ে যান। প্রাণ বাঁচাতে কিছু ভোটার বুথে ঢুকে পড়েন। মনিরুলের কথায়, ‘‘দুই পুলিশ-সহ আমরা ভোটকর্মীরাও ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে থানায় খবর দিই।’’ পুলিশ এলে শুরু হয় ইটবৃষ্টি। পিছু হটে পুলিশ। বুথের দরজা ভেঙে দু’টি ভোটবাক্স লুট করে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।
তখনও মনিরুলেরা বুঝতে পারেননি, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। সে-কথা বলতে গিয়ে এখনও শিউরে শিউরে উঠছেন ওই শিক্ষক। তিনি জানান, কিছু লোক লাঠিসোঁটা হাতে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। গালিগালাজ করতে থাকে। তার পরে ভাঙা চেয়ার আর বেঞ্চের পায়া দিয়ে শুরু হয় বেধড়ক মারধর। ‘‘আমাকে মারতে মারতে বিবস্ত্র করে ফেলে ওরা। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আর কিছু মনে নেই,’’ বললেন মনিরুল।
পুলিশ রক্তাক্ত মনিরুলকে উদ্ধার করে নিউ টাউনের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। মাথায় ১০টি সেলাই পড়ে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলরতন সরকার হাসপাতালে। মনিরুলের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘মারের চোটে ছেলের চোয়াল ভেঙেছে। চিড় ধরেছে বুকের হাড়ে। সরকারি হাসপাতালে তেমন চিকিৎসা না-মেলায় ভিআইপি রোডের পাশে একটি নার্সিংহোমে ওকে ভর্তি করিয়ে দিই। সরকারি কাজে গিয়ে ছেলেটা যখন মৃত্যুমুখে, তখন কারও দেখা মেলেনি। মেলেনি সরকারি সাহায্য।’’
মা-বাবা ছাড়াও আছেন স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে আছেন মনিরুলের। পার্শ্বশিক্ষক হিসেবে পান ৫২০০ টাকা। চিকিৎসায় খরচ হয়ে গিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। স্ত্রী আশরাফুন নাহার বিশ্বাস বলেন, ‘‘সে-দিনের ঘটনা ভুলতে পারছে না ও। ঘুমোতে পারছে না। চিৎকার করে উঠছে। কী ভাবে সামলাব, ভেবে পাচ্ছি না।’’
কী করছে প্রশাসন? উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক অন্তরা আচার্য শুধু বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’