এক ক্যালাইডোস্কোপিক ছেলেবেলা থেকে আমার ডালপালা মেলা শুরু হয়েছিল, তাই আমার জীবনেও নানা রঙের তাপ্পি। ব্রহ্মপুত্রের ধারে এক স্বপ্নের শহর ময়মনসিংহ ছেড়ে কঠিন, ব্যস্ত, যুদ্ধের ছায়ায় বিবর্ণ কলকাতা এবং মিঠে মাটির বিহার হয়ে যখন উত্তর বাংলার মালবাজারে আমাদের প্রায় নির্বাসনের ভয়, তখনই পাহাড় পর্বত বনভূমি আর চাবাগান যেন বর্ণে গন্ধে আশ্চর্য দৃশ্যাবলিতে বাজিকরের খেলা দেখাতে বসে গেল। সাত আট বছরের এক বিমুগ্ধ বালক সেই যে কুহকে সম্মোহিত হয়ে পড়ল, এই গড়ানে বয়সে এসেও তার সেই সম্মোহন যায়নি।
উত্তর বাংলার সেই নিবিড় বনভুমি যে দেখেনি, তার কল্পনাও করা কঠিন কী শ্বাসরোধকারী ভয়ঙ্কর সুন্দর ছিল লাটাগুড়ি বা চালসা নাগরাকাটার অরণ্য। তখন সেই চল্লিশের দশকের শুরুতে মালবাজারে দিনেদুপুরেও চিতাবাঘের আনাগোনা দেখেছি। আমাদের বাংলোর পাশের মাঠে এক দুপুরে খেলা করছিল চারটে চিতাবাঘের বাচ্চা, খুব ইচ্ছে হয়েছিল একটা বাচ্চা নিয়ে এসে পুষি। মা বারণ করল, ‘‘আনিস না, মা-বাঘটা বাচ্চা খুঁজে না পেলে রেগে যাবে।’’
মালবাজার ছেড়ে দোমোহানি। সেও এক সবুজে সবুজে ছয়লাপ জনপদ। মাপে একমুঠো একটা গঞ্জ মতো, ঠাঁটবাট নেই, কিন্তু সেও মাদারির খেল কিছু কম জানত না। ময়মনসিংহের বিরহে কাতর আমার হৃদয়ে তারা মায়াময় অনেক পুলটিস লাগিয়েছে। মাঝে মাঝে চা-বাগানে আমার মামার কাছে বেড়াতে যেতাম।
বেঁটে চা-গাছের অরণ্যে মুগ্ধবৎ ঘুরে বেড়ালে পাখির ডাকে বধির হয়ে যেতে হত।
আর চাবাগানের নির্জনতাও ছিল এত গভীর যে, মনে হত ঘুমিয়ে পড়েছি।
রুজির টানে অনিচ্ছুক আমাকে কলকাতা ঝুঁটি ধরে টেনে নিয়ে এল বটে, কিন্তু সবটা এল না আমার। খানিক আমাকে কেড়ে রেখেছে ময়মনসিংহ, আরও অনেকটা বাঁধা পড়ে আছে উত্তরের আঁচলে।
ভারতবর্ষের একমাত্র আসমুদ্র হিমাচল রাজ্য হল এটা। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার সিঁথি পরে বসে আছে অপরূপা এই ভূখণ্ডটি। গত পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে মানুষ গাছ কেটেছে, মিলিটারি আমদানি হয়েছে, বসতি বেড়েছে, অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে, নগরায়ন হয়েছে বাড়াবাড়ি রকমের, তবু তার রূপ এখনও চেয়ে দেখার মতো।
কতবার আমার মনে হয়েছে ঠিক মতো চেষ্টা করা হলে এই উত্তর বাংলার প্রকৃতিই হতে পারত আমাদের সব চেয়ে বড় আয়ের উৎস। এত ভাল পর্যটনের জায়গা খুব বেশি নেই। সমতলের জঙ্গলগুলোতে কী নির্মমভাবে গাছ কাটা হয়, তা আমিও স্বচক্ষে দেখেছি। তবু সারবান মাটির গুণে এখনও উত্তর ভূখণ্ড ন্যাড়া হয়ে যায়নি।
খুব ইচ্ছে হয়, ছুটি হলে চলে যাবো উত্তরে। ওটাই তো আমার বাড়ি। সেই ছুটি আজও পাওয়া হল না। তবে মাঝে মাঝে এ কথাটা হঠাৎ মনে হয়, বাংলার উত্তরে এক জনপদে আমার একটুখানি ভালবাসার বাড়ি আছে। আর মনটা ভারি মেদুর হয়ে যায়।