State News

জঙ্গলমহলে জমি ফেরাতে ভরসা ‘ভারতী মডেল’?

গত ১৭ মে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পর বান্দোয়ান ব্লকের কুচিয়ার মতোই কুইলাপাল, কুমরার জঙ্গলে ঢাকা ছোট্ট ছোট্ট বসতিগুলি হঠাৎই নজর কেড়েছে।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৮ ১৭:৪৩
Share:

পুলিশকে কি ফের এই ভূমিকায় দেখা যাবে? —ফাইল চিত্র।

ঝাড়খণ্ড সীমানায় পুরুলিয়া জেলার শেষ গ্রাম কুচিয়া। ঘন শাল জঙ্গলের মধ্যে পাথুরে অনুর্বর মাটির ছোট্ট বসতি। পায়ে হেঁটে ঘাটশিলা স্টেশনে পৌঁছতে সময় লাগে বড় জোর এক ঘণ্টা। সেই আপাত নিরীহ প্রান্তিক গ্রামটিই চিন্তায় ফেলেছে প্রশাসনের তাবড় কর্তাদের।

Advertisement

গত ১৭ মে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পর বান্দোয়ান ব্লকের কুচিয়ার মতোই কুইলাপাল, কুমরার জঙ্গলে ঢাকা ছোট্ট ছোট্ট বসতিগুলি হঠাৎই নজর কেড়েছে। এই সীমানাবর্তী প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতেই শাসক দলকে টেক্কা দিয়ে বোর্ড গঠন করার মতো জায়গায় সিপিএম-ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-র অঘোষিত জোট।

গোটা জঙ্গলমহলে শাসক দলের ব্যথা পদ্ম-কাঁটা হলেও, এ রকম প্রান্তিক বসতিতে বাম-জেএমএমের এই বাড়বাড়ন্তয় অশনি সঙ্কেত দেখছেন শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তারা। তাঁদের রক্তচাপ আরও বাড়িয়েছে অযোধ্যা, মাঠা বা বাঘমুণ্ডির মতো এলাকায় শাসক দলের বেহাল দশা। লালগড় আন্দোলনের পুরো সময়— ২০০৮-১২, এই তিনটি ব্লকের অধিকাংশ জায়গা মাওবাদীদের দাপটে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। সেই ‘কুখ্যাত’ এলাকায় পায়ের তলার মাটি হারিয়েছে শাসক দল।

Advertisement

আরও পড়ুন
মমতার প্রার্থীর হার, বিশ্লেষণে কঠোর দল

নির্বাচনের ফল ঘোষণার এক দিন পরেই গত ১৯ মে দুর্গাপুর পৌঁছন রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ। তাঁর ডাকা বৈঠকে ছিলেন আইজি পশ্চিমাঞ্চল রাজীব মিশ্র, দুর্গাপুর-আসানসোলের পুলিশ কমিশনার এল এন মিনা এবং পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম— জঙ্গলমহলের তিন জেলার পুলিশ সুপাররা। পরে ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ শনিবারের বৈঠককে রুটিন বলে দাবি করেন।

কিন্তু শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের সূত্রের খবর, ওই তিন জেলায় নির্বাচনের ফল দেখে রীতিমতো আশঙ্কিত প্রশাসন। ওই বৈঠকে ডিজি গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়েও আলোচনা করেন। সেই রিপোর্টে জঙ্গলমহলের তিন জেলার ফল প্রত্যাশিত বলেই দাবি করা হয়েছে। এক পুলিশ কর্তা বলেন, “২০০৭-০৮ সালেও একই ভাবে এই এলাকাতে তখনকার শাসক বামদলগুলির উপর আস্থা হারিয়েছিল মানুষ। সেই অসন্তোষ যে কতটা মারাত্মক আকার নিতে পারে তা হাড়ে হাড়ে জানি আমরা। তাই আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করছি।”

আরও পড়ুন
সন্ধ্যা ৭টার পর প্রচার নয় সোশ্যাল মিডিয়ায়

সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে ঝাড়গ্রামের থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পুরুলিয়া। কারণ, ঝাড়গ্রামে বিজেপির এই উত্থানের পিছনে শাসক দলের তীব্র কোন্দলকেই দায়ী করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, ঝাড়গ্রামে বিজেপি সাংগঠনিক দিক থেকে খুব শক্তিশালী হয়েছে এমন নয়। শিমুলপাল, ভুলাভেদা, বাঁশপাহাড়ির মতো কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়া বাকি এলাকাতে প্রাক্তন এবং বর্তমান মন্ত্রীর লড়াই থামাতে পারলেই পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এমনটাই দাবি করা হয়েছে এই রিপোর্টে। তবে পুরুলিয়ার ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল, তা স্বীকার করেন অন্য এক গোয়েন্দা কর্তা। তাঁর কথায়, “পুরুলিয়ার সাম্প্রতিক সমীকরণ পুরোটাই আলাদা। সেখানে অযোধ্যা, বাঘমুণ্ডির বিস্তীর্ণ এলাকায় বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গত কয়েক বছরে সাংগঠনিক দিক থেকে যথেষ্ট জোর বাড়িয়েছে। অন্য দিকে, প্রান্তিক এলাকাতে নিচুতলায় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং সিপিএম কী ভাবে শক্তি পাচ্ছে সেটাই রহস্য।”মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি দাবি করেছেন, ঝাড়খণ্ড থেকে লোকজন ঢুকছে এই সব এলাকাতে। গোয়েন্দা রিপোর্টেও সেরকমই সন্দেহভাজনদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারা মাওবাদী না অন্য কেউ সেটা নির্দিষ্ট করে বলা নেই এই রিপোর্টে।

সূত্রের খবর, শনিবার দুর্গাপুরে রাজ্য পুলি‌শ প্রধান ওই এলাকাতে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি থানা পর্যায়ে পুলিশকে আরও উদ্যোগী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। থানা এলাকায় কাজ করা সিভিক ভলান্টিয়ার এবং হোমগার্ডরা যাতে প্রত্যন্ত গ্রামেও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে তাঁদের অসন্তোষের আগাম হদিশ পান, সে জন্য আরও তৎপর হতে বলা হয়েছে ওই বৈঠকে। ইতিমধ্যেই এই তিন জেলার বিভিন্ন গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে উন্নয়ন এবং অসন্তোষের খতিয়ান নেওয়া শুরু করেছেন বিভিন্ন থানার সিভিক ভলান্টিয়াররা।

আর সেখানেই আশঙ্কা বাড়ছে ওই তিন জেলার শাসক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মীদের। পুরুলিয়ার বলরামপুরের এক তৃণমূল নেতার উক্তি, “ভারতী ঘোষকে এ রকমই দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। তার ফল কী হয়, সেটাও দেখা গিয়েছে।” একই আশঙ্কা বেলপাহাড়ির এক তৃণমূল নেতার। তিনি বলেন, “ভারতীর ভূত এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে এলাকার মানুষকে। পুলিশ অসন্তোষ কমানোর বদলে সব সময় বাড়িয়ে দেয়।” বিরোধীদের আতঙ্ক আরও বেশি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র সৌরীশ মুখোপাধ্যায়ের বলেন, “গত তিন দিনে পুরুলিয়া জেলাতে আমাদের দু’জন শীর্ষ সংগঠক গৌরব সিংহ এবং সূর্য শর্মাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই গ্রেফতারি পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কারণ, জেলায় বিজেপির ভাল ফলের পিছনে এই দু’জনের অবদান রয়েছে।”

বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি হোক বা অগুরুত্বহীন রাজনৈতিক দলের রহস্যময় বাড়বাড়ন্ত— সব মিলিয়ে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পুরুলিয়াকে ঘিরে আশঙ্কিত প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। সেই মেঘ কাটাতে, পুলিশি নির্ভরতা পাল্টা আতঙ্ক-অবিশ্বাসের আবহ তৈরি করছে জঙ্গলখণ্ডে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন