ঠুনকো টোটো ভেঙে ই-রিকশা তৈরির ভাবনা

বছরখানেক আগেও হাওড়ার ডুমুরজলায় একটাই ঝালাইয়ের দোকান ছিল। দু’-একটা ট্যাক্সি ও রিকশার চিড় খাওয়া অংশ জোড়া লাগিয়ে গোটা দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন কালু মিস্ত্রিরা (লোকে এ নামেই ডাকে)।

Advertisement

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১
Share:

বছরখানেক আগেও হাওড়ার ডুমুরজলায় একটাই ঝালাইয়ের দোকান ছিল। দু’-একটা ট্যাক্সি ও রিকশার চিড় খাওয়া অংশ জোড়া লাগিয়ে গোটা দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন কালু মিস্ত্রিরা (লোকে এ নামেই ডাকে)। এখন সেখানে সারি সারি ঝালাইয়ের দোকান এবং সেই কালুদের এখন দম ফেলার সুযোগ নেই। কেননা সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় টোটো ঝালাই। দোকানের ঝাঁপ ফেলতে রাত ১১টা বেজে যায়। পরের দিন দোকান খুলতে না-খুলতেই আবার সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে টোটোর পর টোটো।

Advertisement

আসলে ঠুনকো, পলকা লোহায় বানানো টোটোর দাপট যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝালাইকরদের রমরমা। কেননা অশক্ত লোহার টোটো হরদম হোঁচট খাচ্ছে। তাদের জখমে প্রলেপ দিতে ডাক পড়ছে ঝালাই দোকানি কালু মিস্ত্রিদের।

মঙ্গলবার ডুমুরজলা স্টেডিয়াম লাগোয়া এক ঝালাই দোকানে গিয়ে দেখা গেল, টোটোচালকের সঙ্গে কালু মিস্ত্রির তুমুল কথা কাটাকাটি চলছে। চালকের অভিযোগ, তিন দিনও চলছে না, ঝালাই খুলে যাচ্ছে। কালুর পাল্টা দাবি, এত ঠুনকো গাড়িতে এক বারের বেশি ঝালাই করা যাবে না। করলেও টিকবে না। কালু মিস্ত্রির দাবি যে অনেকাংশে ঠিক, তা নিয়ত টের পাচ্ছেন হাওড়াবাসী। দেখছেন, ঘেয়ো কুকুরের মতো গোটা গায়ে ঝালাইয়ের চিহ্ন নিয়ে চলতে চলতে কোনও কোনও টোটো হ্যান্ডেল ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ছে, কখনও বা পিছনের বাম্পার ঘষটাচ্ছে বিকট শব্দে। মানুষ সব দেখছেন। তবু নিরুপায় হয়ে চেপে বসছেন সেই ঝালাই করা টোটোতেই।

Advertisement

ডুমুরজলা একটা উদাহরণ মাত্র। ব্যবসার হাল ফেরার আশায় গোটা হাওড়া জেলাতেই এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ঝালাইয়ের দোকান। কেননা রোগটা ধরেছেন কালু মিস্ত্রিরা। এবং তাঁরাই যে নিদান হাঁকছেন, টোটোয় এক বারের বেশি ঝালাই দেওয়ার জো নেই, সেই দাবিতে সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রক। আইন সংশোধন করে কেন্দ্র জানিয়েছে, অশক্ত টোটো আর পথে নামবে না। তার জায়গায় চলবে শুধু ই-রিকশা।

‘‘ই-রিকশা দেখতে টোটোর মতোই। তবে তুলনায় শক্তপোক্ত। পুণের ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব রোড ট্রান্সপোর্ট’-এর মতো একাধিক বিশেষজ্ঞ সংস্থার শংসাপত্র পাওয়ার পরে ই-রিকশাকে পথে নামার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্র,’’ বলছেন রাজ্য পরিবহণ দফতরের এক কর্তা।

এই তিন চাকার যানকে শৃঙ্খলার নিয়মকানুনে বাঁধতে তাদের মোটর ভেহিকল্‌স বা মোটরযান আইনের আওতায় আনার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। ফলে পুরসভা ও পঞ্চায়েতের দেওয়া টোটোর ‘টেম্পোরারি আইডেন্টিফিকেশন নম্বর’-এর আর অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু কোথায় কী! প্রায় আট মাসে আগে কেন্দ্রের নতুন আইন চালু হলেও এ রাজ্যে টোটোরাজ চলছে বহাল তবিয়তে। তবে পরিবহণকর্তাদের আশ্বাস, অনেকে হয়েছে। খুব শীঘ্রই সব টোটোকে ভেঙেচুরে ‘স্ক্র্যাপ’ বা লোহালক্কড়ে পরিণত করা হবে। তার পরিবর্তে রাস্তায় নামবে ই-রিকশা।

কেন ভাঙা হবে টোটো?

যাত্রিসাধারণের ঝুঁকি এড়াতে এবং ই-রিকশার পথ পরিষ্কার করতেই টোটো ভাঙা হবে বলে পরিবহণ দফতরের খবর। পরিবহণকর্তারা বলছেন, বেশ কিছু ই-রিকশা প্রস্তুতকারক সংস্থা প্রস্তাব দিয়েছে, টোটোর ব্যাটারি ও চার্জার ঠিক থাকলে সেগুলি নতুন গাড়িতে ব্যবহার করা হবে। এতে কিছু আর্থিক সুবিধে হবে ক্রেতাদের। উপরন্তু পুরনো টোটো ভেঙে যে-পরিমাণ লোহালক্কড় মিলবে, তার মূল্যও ই-রিকশার দাম বাদ দেওয়া হবে। ফলে সব মিলিয়ে একটা ই-রিকশার দাম দাঁড়াবে ৭৫-৮০ হাজার টাকা। অথচ খোলা বাজারে তার দাম এক লক্ষ ৩০ হাজার টাকা হাঁকছেন দোকানিরা। অর্থাৎ ভাঙা টোটোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনর্ব্যবহারের সুবাদে ই-রিকশার দাম কম পড়বে অনেকটাই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসেই বারাসতে শতাধিক টোটো ভেঙে সংশ্লিষ্ট চালকদের হাতে নয়া ই-রিকশা তুলে দেওয়া হবে। ওই পরিবহণকর্তা বলেন, ‘‘অর্থে টান পড়লে সরকারের ‘গতিধারা’ প্রকল্প আছে। ক্রয়মূল্যের ৩০ শতাংশ, সর্ব্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা ভর্তুকি মিলবে এই প্রকল্পে।’’

ই-রিকশা কেনার পরেই আঞ্চলিক ভিত্তিতে লাইসেন্স দেবে পরিবহণ দফতর। তার আগে কোন এলাকায় ওই রিকশা চলবে, তা জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট মালিককে। পরিবহণকর্তারা ঠিক করেছেন, লাইসেন্সেও এলাকার উল্লেখ থাকবে, যাতে কেউ অন্যের এলাকায় ঢুকে যাত্রী তুলতে গিয়ে ধরা পড়লে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে।

রাজ্যে এখন দেড় লক্ষের বেশি টোটো চলে। বহু পরিবার এর উপরে নির্ভরশীল। রাতারাতি টোটো বাতিল হলে তারা সমস্যায় পড়বে। তাই বিকল্প পথ খুঁজতে কিছুটা সময় গেল, বক্তব্য পরিবহণ দফতরের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন