মাথাই নেই, খাবি খাচ্ছে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধড়

ছ’টি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ৮৮টি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে তার অধীনে। ওই সব প্রতিষ্ঠান তার বৃহত্তর শরীরের অংশ। আছে তার অন্যান্য প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ নানান দফতরও। নেই শুধু মাথা। নেই উপাচার্য।

Advertisement

সুপ্রিয় তরফদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৬
Share:

ছ’টি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ৮৮টি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে তার অধীনে। ওই সব প্রতিষ্ঠান তার বৃহত্তর শরীরের অংশ। আছে তার অন্যান্য প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ নানান দফতরও। নেই শুধু মাথা। নেই উপাচার্য। মাথা না-থাকলে শরীরের যা হয়, রাজ্যের উপাচার্যহীন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা-ই হচ্ছে। অর্থাৎ কোনও কাজই ঠিকঠাক হচ্ছে না।

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, মাস দুয়েক আগে প্রয়াত হয়েছেন উপাচার্য রঞ্জন ভট্টাচার্য। তার পর থেকে প্রতিষ্ঠানের মস্তিষ্কপ্রতিম ওই শীর্ষ পদ খালি। দু’মাস পেরিয়ে গেলেও বিটেক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়নি। অথচ পরীক্ষা শেষের ৪০ দিনের মধ্যে তা ঘোষণা করার কথা। ফল না-বেরোনোর ফল ভুগতে হচ্ছে পড়ুয়াদের। বছরের অধিকাংশ দিন ক্লাসই হয় না। এই ধরনের হাজারো অভিযোগ শুধু পড়ুয়াদের নয়, শিক্ষকদেরও। হয়নি এবং হচ্ছে না আরও অনেক কিছুই। উচ্চশিক্ষা দফতর জানাচ্ছে, ২০০০ সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয় বিধানসভায়। পঠনপাঠন শুরু হয় ২০০১-এ। অথচ এখনও পর্যন্ত তার ‘স্ট্যাটিউট’ বা বিধিই তৈরি হয়নি!

এত অব্যবস্থা কেন?

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর, ২০১২ সালের নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্য মারা গেলে সহ-উপাচার্য নিজে থেকেই সেই দায়িত্বভার তুলে নিতে পারেন না। উপাচার্য নিয়োগের আবেদন জানিয়ে রেজিস্ট্রার উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিবকে চিঠি লেখেন। উচ্চশিক্ষা দফতর রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আবেদন এখনও পড়ে আছে উচ্চশিক্ষা দফতরেই। উপাচার্যের আসনও তাই খালি থেকে গিয়েছে।

মস্তিষ্কের যথাযথ নির্দেশের অভাবে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ প্রায় অচল। এর ফল কত দূরপ্রসারী হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক সেই দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন। বলছেন, উপাচার্য নেই, এই কারণ দেখিয়ে ডিসেম্বরে ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল বা নাক-এর কাছে সবিস্তার তথ্য জমা দেওয়া যায়নি। কারণ, ওই নথিতে উপাচার্যের সই দরকার। ওই তথ্য নাক-এর কাছে জমা না-পড়ায় উন্নয়নের টাকা আটকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়েরই।

এখনকার ছ’টি সরকারি এবং ৮৮টি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তো আছেই। তার উপরে চলতি বছরেই পুরুলিয়া ও কোচবিহারে আরও দু’টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চালু করার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সেগুলোও আসবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অথৈ জলে। সেখানকার এক কর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানের সমস্ত প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব মূলত রেজিস্ট্রারের উপরে ন্যস্ত। এখন যিনি ওই পদে আছেন, তাঁকে রাখা হয়েছে কার্যকাল বাড়িয়ে। বর্ধিত মেয়াদ শেষ হলে এপ্রিলে তিনি চলে যাবেন। তার পরে ওই পদে বসার মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডেপুটি রেজিস্ট্রার নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে এপ্রিলের পরে কী হবে, তা নিয়ে ঘোর সংশয়ে বিশ্ববিদ্যালয়।

পঠনপাঠনও চলেছে নাম-কা-ওয়াস্তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-পদ মোট ৫৪টি। কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র ১৩ জন। এবং তাঁদের এক জনও প্রফেসর স্তরের নন। এক জন শিক্ষককে আবার কন্ট্রোলার অব এগ্‌জামিনেশন বা পরীক্ষা নিয়ামকের কাজও সামলাতে হচ্ছে। বিটেকের ছাত্র অর্ণব বসু বলেন, ‘‘শিক্ষক কম থাকায় কখনওই ঠিকমতো ক্লাস হয় না। এত কিছু মেনে নিয়েও পড়ুয়ারা পরীক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু ডিসেম্বরে পরীক্ষা দিয়েও তাঁরা তার ফল জানতে পারছেন না।’’ পড়ুয়াদের দিক থেকে আপাতত সব চেয়ে বড় সমস্যা অপ্রকাশিত ফল নিয়ে। ৪০ দিনের মধ্যে ফলপ্রকাশের নিয়ম অনুযায়ী ডিসেম্বরে চুকে যাওয়া পরীক্ষার ফল এত দিনে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়ে দিয়েছেন, পরীক্ষার ফলপ্রকাশে দেরি হলে তার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসককেই। প্রশ্ন উঠছে, যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যই নেই, সেখানে কে সেই দায় নেবেন? কী বলছেন কর্তৃপক্ষ?

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা জানান, এক সময় একসঙ্গে একটি জায়গায় বসে খাতা দেখার নিয়ম চালু ছিল। তাতে কোনও সমস্যা হতো না। লেদার প্রযুক্তি কলেজের পিছনে যে-জায়গা রয়েছে, সেখানে ২০ দিন ধরে প্রায় ৫০০ পরীক্ষককে দিয়ে খাতা দেখানো হতো। তার পরে সেখানেই নির্দিষ্ট জায়গায় খাতা রেখে শিক্ষকেরা বাড়ি চলে যেতেন। কিন্তু বছর তিনেক আগে উপাচার্যের আসনে বসে রঞ্জনবাবু সেই নিয়ম বদলে দেন। তিনি প্রত্যেক শিক্ষককে আলাদা করে খাতা দেখতে হবে বলে জানান। তাতেও অবশ্য ফল বেরোতে দেরি হয়নি। কিন্তু রঞ্জনবাবুর মৃত্যুর পরে আবার সেই পুরনো নিয়ম চালু করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এর ফলে নতুন করে নিয়মনীতি বানাতে এবং তা মঞ্জুর করতে বাড়তি সময় খরচ হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়েই ফল বেরোতে দেরি হচ্ছে। সহ-উপাচার্য সুব্রত দে বলেন, ‘‘পুরনো নিয়মে ফিরে যাওয়ায় খাতা দেখতে দেরি হয়েছিল। সেই সমস্যা মিটে গিয়েছে। খাতা দেখা শেষ। দ্রুত ফল বেরোবে।’’

প্রশ্ন উঠছে, ফলপ্রকাশের সমস্যা কিছু দিন পরে মিটে গেলেও অন্যান্য সমস্যা মিটবে কবে?

সুব্রতবাবুর আশ্বাস, ‘‘দ্রুত সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চলছে।’’ আর শিক্ষামন্ত্রী জানাচ্ছেন, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার কথা তাঁর অজানা নেই। ‘‘ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন। সমস্যা হচ্ছিল। নতুন উপাচার্য আসবেন। তার পরে শীঘ্রই বাকি পদ পূরণ করা হবে। বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে,’’ আশ্বাস পার্থবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন