স্বাধীনতা-সংগ্রামীর স্মৃতি ও ঐতিহ্যের সাক্ষী বক্সা দুর্গ সংস্কার, সংরক্ষণের কাজ দ্রুত শুরুর নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই দুর্গকে কেন্দ্র করে পর্যটনের মানোন্নয়নে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বক্সা-সংস্কারে বরাদ্দ অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকের কাছে। কাজটা করবে পূর্ত দফতর। কী ভাবে হবে সংস্কার ও সংরক্ষণ, তা নিয়ে সম্প্রতি ‘নবান্ন’য় আলোচনা করেন প্রশাসনের কর্তারা।
আইনি নির্দেশে ২০১০ থেকে বক্সা-অরণ্যে ‘কার-সাফারি’ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২-র অক্টোবর মাসে সুপ্রিম কোর্ট এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় বিভিন্ন সংগঠনের তরফে সেখানে পর্যটনের পরিকাঠামো তৈরি ও বক্সা সংস্কার-সংরক্ষণের আর্জি যায় রাজ্যের কাছে। ২০১৪-র ৫ জুন উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বক্সার পর্যটন এবং দুর্গ সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করেন। তার পর বিভিন্ন স্তরে এই বিষয়টি নিয়ে কথা চলছিল।
১৯৩০-১৯৩৭ ও ১৯৪২-১৯৪৭ এখানে ছিল ইংরেজদের বন্দিশিবির। এর পর বছর তিন ছিল পুরোদস্তুর কারাগার। এখানে আটক ছিলেন অগ্নিযুগের বেশ কিছু দাপুটে সংগঠনের বন্দিরা। বক্সা সংস্কার প্রকল্পের পরামর্শদাতা-স্থপতি আশিস আচার্য বলেন, ‘‘নিরাপত্তার স্বার্থেই আন্দামান ও বক্সার মতো দুর্গম এলাকায় বন্দিশিবির তৈরি করেছিল ইংরেজরা। এখানে স্বল্প সময়ের জন্য বন্দি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুও। অন্যদের মধ্যে প্রথমেই মনে আসে ভূপেন মজুমদার, ত্রৈলোক্য মহারাজ, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের হেমচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের নাম।’’ শেষ দিকে বন্দিদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫১-তে শিবিরটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়।
রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উপ-অধিকর্তা প্রভাকর পাল বলেন, ‘‘বক্সা সংস্কার-সংরক্ষণ নিয়ে রাজ্য উদ্যোগী হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের বিশদ সমীক্ষা পাঠানো হয়েছে ‘নবান্ন’য়। প্রস্তাবিত প্রকল্প ব্যয়ের ৪ কোটি ৮২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আলিপুরদুয়ারে জেলাশাসকের বিশেষ অ্যাকাউন্টে। ওই জেলায় এডিএম থাকাকালীন বক্সা দুর্গ সংস্কারের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সদ্য অন্যত্র বদলি হওয়া দেবীপ্রসাদ করণম। তিনি বলেন, ‘‘বন দফতর কিছু সৌন্দর্যায়নের কাজ করেছে। এবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দুর্গ এবং সংলগ্ন ভবন সংস্কার করবে।’’
কাজটা হবে কী ভাবে? আশিস আচার্য বলেন, ‘‘প্রায় কিছুই ওখানে অবশিষ্ট নেই। তবে, সেগুলোর পুনর্নির্মাণ সম্ভব। সমস্যা যেটা, প্রায় ৬ কিলোমিটার ট্রেক করে ওই সাবেক দুর্গে যাওয়ার পথ দুর্গম। এই পথে ৫০০ মিটার অন্তর, বিশ্রামস্থল এবং দুর্গের পাশে অতিথিশালা করা দরকার।’’ তিনি জানান, শ্বেতপাথরের ফলকে কবিগুরুর উদ্দেশে ওখানকার বন্দিদের লেখা কবিতাটি রয়েছে। ওটির সংস্কার দরকার। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্র-জন্মদিবসে তাঁকে উদ্দেশ করে বক্সার বন্দিরা ওই কবিতা লেখেন। কবিতার শুরু এ ভাবে—‘‘ওগো কবি/ তোমায় আমরা করি গো নমস্কার’’।
আলিপুরদুয়ার থেকে ৩০ কিমি দূরে ২৮৪৪ ফুট উচ্চতায় বক্সা দুর্গ। এ কথা জানিয়ে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পদস্থ আধিকারিক বিনয় মণি বলেন, ‘‘যতটুকু জানা গিয়েছে, সপ্তম শতকে প্রথম কোচ রাজা সঙ্গলদ্বীপ এটি তৈরি করান। এলাকার দখল নিয়ে ভুটান ও কোচ রাজাদের মধ্যে কিছুকাল হানাহানি চলে। ১৮৬৪-র ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ আক্রমণের পর ১৮৬৫-র ১১ নভেম্বর ‘সিঞ্চুলা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এর ভিত্তিতে দুর্গটি ব্রিটিশদের অধীনে যায়। বাঁশ-কাঠের তৈরি দুর্গ তাঁরা পোক্ত করেন পাথর-ইঁটে। ১৮৭৩ সালে এটি বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি ব্যারাক হয়। ১৯৫৯-র মার্চ মাসে চিনা সেনার হামলার পর বহু তিব্বতি পরিবার বক্সা দুর্গে এসে থাকতে শুরু করে। তাদের সরাতে ১৯৬৬-তে সক্রিয় হয় ভারত সরকার। তাতে দলাই লামাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে কয়েকশো শরনার্থী ডেরা বাঁধে এখানে। পরে তাদেরও সরিয়ে দেওয়া হয়।