গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
একদা নৈহাটির লাগোয়া ভাটপাড়া ছিল সংস্কৃত পণ্ডিতদের চর্চার কেন্দ্র। টোলের সে সমস্ত পণ্ডিতকে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি দিত ব্রিটিশেরা। লেখা হত পুঁথি। সেই ভাটপাড়ায় সংস্কৃত চর্চা প্রায় উঠেই গিয়েছে। তবে ‘সংস্কৃতি’ আছে। যে সংস্কৃতিকে অনেকে বলেন ‘দবং’। যার সঙ্গে জুড়ে আছে গুলি-বন্দুক-বোমা ইত্যাদি।
এ হেন ভাটপাড়ায় ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে পদ্মশিবিরের প্রার্থী কে হবেন? কে লিখবেন ভোটের পুঁথি? পিতা অর্জুন সিংহ না কি পুত্র পবন সিংহ? প্রকাশ্যে না-বললেও এই প্রশ্নে খানিকটা আতান্তরে বিজেপি।
২০১৯ সালে বিধানসভা উপনির্বাচনে জিতে প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন অর্জুনপুত্র পবন। তার পরে জেতেন ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও। তিনিই ভাটপাড়ার বর্তমান বিধায়ক। পিতা অর্জুন বাম জমানা থেকে ভাটপাড়ায় জিততেন। তিনি ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যান। পদ্মশিবির তাঁকে প্রার্থী করে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে। ২০১৯ সালের রাজ্যে বিজেপির বিজেপির উত্থানের হাওয়ায় অর্জুন জিতে সাংসদ হন। তাঁর ছেড়ে আসা বিধানসভায় জিতে বিধায়ক হন পুত্র পবন।
কিন্তু ২০২৬ সালের আগে পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ, এখন অর্জুন আবার বিজেপিতে। বিজেপি থেকে জিতে মধ্যমেয়াদে তৃণমূলে চলে গিয়েছিলেন অর্জুন। কিন্তু ২০২৪ সালের ভোটে তাঁকে ব্যারাকপুরে টিকিট দেয়নি তৃণমূল। ব্রিগেডের সমাবেশে তাঁর বদলে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের নাম ঘোষণা হতেই মঞ্চ ছেড়ে নেমে গিয়েছিলেন অর্জুন। সেই যাত্রা শেষ হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর দোরগোড়ায়। রাজ্যের বিরোধী দলনেতার হস্তক্ষেপেই ব্যারাকপুরে বিজেপি টিকিট দিয়েছিল অর্জুনকে। অন্য ‘যোগ্য’ প্রার্থীকে বঞ্চিত করেই। কিন্তু ঘনঘন দল বদলানো অর্জুন ব্যারাকপুর জিততে পারেননি। এখন তিনি পরিষদীয় বা সংসদীয় রাজনীতীর কোনও স্তরেই নেই। অর্থাৎ, তাঁর আম এবং ছালা— উভয়ই গিয়েছে। উপরন্তু, কয়েক বছর আগে চলে গিয়েছে পুরসভার চেয়ারম্যান পদও। ফলে ‘নিঃস্ব’ অর্জুন যে বিধানসভায় একটা ‘প্রত্যাবর্তন’ চাইবেন, তা সহজবোধ্য। কিন্তু কোন কেন্দ্রে? পুত্র পবনকে সরিয়ে নিজের পুরনো বিধানসভা কেন্দ্র ভাটপাড়ায়? না কি অন্যত্র?
অর্জুন এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বিজেপি নেতারা আনুষ্ঠানিক ভাবে বলছেন, এখনও এ সব নিয়ে আলোচনার সময় আসেনি। তবে তলায় তলায় অঙ্ক কষা চলছে সিংহবাড়িতে। অর্জুন অনুগামীদের একাংশের বক্তব্য, পুত্র পবন যেমন ভাটপাড়ায় আছেন তেমনই থাকবেন। পবনপিতা লড়বেন আশপাশের কোনও আসন থেকে। যার মধ্যে নৈহাটির নাম রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ভোটের নিরিখে নৈহাটি ‘কঠিন’। তুলনায় জগদ্দল ‘সহজ’।
কেন অর্জুনের জন্য নৈহাটি কঠিন? ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নৈহাটিতে তৃণমূলের পার্থ (এখন ব্যারাকপুরের সাংসদ) জিতেছিলেন প্রায় ১৯ হাজার ভোটে। ২০২৪ সালের উপনির্বাচনে সেই নৈহাটিতে তৃণমূলের সনৎ দে জিতেছেন ৪৮ হাজার ভোটে। যদিও উপনির্বাচনের হিসাবকে ধরছে না বিজেপি। কিন্তু তারা দেখছে, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে অর্জুন নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রে পিছিয়ে ছিলেন ১৫ হাজার ভোটে। আর জগদ্দলে পিছিয়ে ছিলেন ২০০০ ভোটে। এই ফলাফলেই বোঝা যাচ্ছে, সাধারণ পাটিগণিতের অঙ্কে নৈহাটির তুলনায় জগদ্দল অর্জুনের জন্য তুলনায় সহজ। জগদ্দলের ভোটের রেখাচিত্রও বলছে, সেখানে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। সেখানে ২০২১ সালে তৃণমূল জিতেছিল ১৯ হাজার ভোটে। সেই ব্যবধান লোকসভায় কমে হয়েছে ২০০০। যদিও রাজনীতি সবসময় সরল পাটিগণিত মেনে হয় না। সেখানে হাজারো সমীকরণ কাজ করে। তা ছাড়া, বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটের বিষয়, ভোটারদের মানসিকতা ইত্যাদিও আলাদা হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, তৃণমূলও জেতা আসন সংহত রেখে ভাটপাড়া কেড়ে নেওয়ার কৌশলে মনোনিবেশ করেছে। লোকসভায় জিতে তাঁর সাংসদ তহবিলের ২ কোটি টাকা ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের জন্য দিয়েছেন ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ। শুধুমাত্র ভাটপাড়া পুর এলাকায় অপরাধ রুখতে ৮৫ লক্ষ টাকা খরচ করে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন। হিংসায় দীর্ণ ভাটপাড়ায় উন্নয়নের মডেল খাড়া করতে চাইছে শাসকদল। সমান্তরাল ভাবে চলছে সাংগঠনিক প্রক্রিয়াও।
ব্যারাকপুরের রাজনীতিতে অর্জুনের উত্থান বাম জমানায়। ব্যারাকপুরের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তড়িৎ তোপদারের সঙ্গে তাঁর ‘সখ্য’ সর্বজনবিদিত। কিন্তু সেই অর্জুন গত কয়েক বছরে তিন তিনবার দল বদল করে রাজনৈতিক জমি হারিয়েছেন। ভাটপাড়া ছাড়া কোনও এলাকাই আর সে ভাবে তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। যে ভাটপাড়ায় বিধায়ক তাঁর পুত্র। যিনি শুভেন্দুর ‘আস্থাভাজন’ বলে পরিচিত।
ভাটপাড়ায় প্রার্থী হবেন কে? কে লিখবেন পদ্মের ভোটের পুঁথি? পিতা না পুত্র? অর্জুন না পবন? সেই প্রশ্নই আপাতত ঘুরছে ব্যারাকপুরে। ঘুরছে রাজ্য বিজেপির অন্দরেও।