Abhishek Banerjee on SIR

১০০% এনুমারেশন ফর্ম জমা দিতে দলকে চাপ দিয়েছেন অভিষেক! তৃণমূলে খবর নিয়ে তার পাঁচটি কারণ পেল আনন্দবাজার ডট কম

১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানোর নির্দেশিকা নিয়ে তৃণমূলের অনেকের মধ্যেই নানা ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে অভিন্ন সুরে প্রায় সকলেই একটা কথা বলছেন, এসআইআর-এর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দলকে মাঠে নামিয়ে জনমানসে এমন একটি ধারণা অভিষেক তৈরি করতে চাইছেন যে, এমন উৎকণ্ঠার সময়ে তৃণমূল ছাড়া কেউ মাঠে নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:০১
Share:

দলের নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

দলের ২৫ হাজার নেতার সঙ্গে সোমবার ভার্চুয়াল বৈঠক করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভ্যন্তরীণ সেই বৈঠকে সওয়া দু’ঘণ্টার বক্তৃতায় অন্তত চার-পাঁচ বার অভিষেক একটা বিষয়েই গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। সেটি হল, ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় (এসআইআর) ১০০ শতাংশ ‘এনুমারেশন ফর্ম’ যাতে জমা পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃণমূল সূত্রের খবর, অভিষেক এ-ও বলেছেন যে, ৯৮-৯৯ শতাংশ নয়, ১০০ শতাংশ ফর্মই যাতে জমা পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে নেতাদের। আগামিদিনে দলের পদে থাকার সূচকও হবে ‘এনুমারেশন ফর্ম’ জমা করতে পারা বা না-পারা।

Advertisement

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী এসআইআর-এর ফর্ম বিলি করছেন কমিশন নিযুক্ত বুথ লেভেল এজেন্টরা (বিএলও)। তা সংগ্রহও করছেন তাঁরা। তার পর সেই বিএলও-রাই সেই ফর্ম জমা দিচ্ছেন ব্লক স্তরে। এই বিএলও-দের সঙ্গে ছায়াসঙ্গীর মতো লেগে থাকছেন রাজনৈতিক দলগুলির নিযুক্ত বুথ লেভেল এজেন্টরা (বিএলএ)। যে কাজে বাকিদের তুলনায় তৃণমূলকেই এখনও পর্যন্ত বেশি সক্রিয় দেখাচ্ছে। ফর্ম জমা দেওয়ার যে কাজ কমিশন নিযুক্ত বিএলও-দের, সেই কাজের ব্যাপারে কেন দলীয় সংগঠনকে এতটা চাপ দিচ্ছেন অভিষেক? কী কারণেই বা তিনি ১০০ শতাংশ ‘এনুমারেশন ফর্ম’ জমা করাতে চাইছেন?

১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানোর অভিষেকের ওই নির্দেশিকা নিয়ে তৃণমূলের অনেকের মধ্যেই নানা ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে অভিন্ন ভাবে প্রায় সকলেই একটা কথা বলছেন যে, এসআইআর-এর মতো ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে দলকে মাঠে নামিয়ে জনমানসে অভিষেক এমন একটি ধারণা তৈরি করতে চাইছেন যে, এমন উৎকণ্ঠার সময়ে তৃণমূল ছাড়া কেউ মাঠে নেই। তৃণমূলের অন্দরে খোঁজ নিয়ে তার পাঁচটি কারণ খুঁজে পেয়েছে আনন্দবাজার ডট কম।

Advertisement

চাপে রাখো কমিশনকে

তৃণমূলের প্রথম সারির একাধিক নেতার বক্তব্য, অভিষেকের রাজনীতির ঘরানা ‘কর্পোরেট’ ধাঁচের। কর্পোরেটে যেমন লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে রাখা হয়, তেমনই এখানেও করা হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, ‘বস্‌’ হিসাবে অভিষেকও জানেন, সর্বত্র ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানো সম্ভব নয়। কারণ মৃত, স্থানান্তরিত, দু’জায়গায় নাম থাকা ভোটারেরা রয়েছেন। তাঁদের ফর্ম জমা পড়া মুশকিল। মৃতদের ফর্ম তথ্য দিয়ে পরিবারের লোক জমা দিলেও স্থানান্তরিত বা দু’জায়গায় নাম থাকা ভোটারদের ক্ষেত্রে তা হবে না। কিন্তু তা-ও অভিষেক ১০০ শতাংশে জোর দিয়েছেন আসলে কমিশনকে চাপে রাখতে। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, দলকে এই চাপ দিলে তা তরান্বিত হবে বিএলও-দের উপর। আসলে যা চাপ তৈরি করবে নির্বাচন কমিশনের উপরেও। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ যা হিসাব, তাতে শাসকদলও জানে, ফর্ম পূরণ করা বড়সংখ্যক ভোটার ২০০২-এর তালিকায় কারও নাম দেখাতে পারবেন না। কিন্তু তার জন্য যাতে ফর্ম জমা দেওয়া না-আটকায়, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’। তাতে শুনানি পর্বে সংখ্যা বেশি হলে কমিশনের উপর চাপ তৈরি করতে পারবে শাসকদল। যা তুলে ধরা যাবে ‘রাজনৈতিক ভাষ্য’ হিসাবেও। ভুয়ো ভোটার বা রোহিঙ্গাদের নাম থাকার যে অভিযোগ বিজেপি বা বিরোধীরা করছে, ফর্ম জমার সংখ্যা যত বাড়বে, বিরোধীদের সেই অভিযোগকেও তত রাজনৈতিক ভাবে ভোঁতা করা যাবে।

দ্বিতীয় পর্বের ভিত তৈরি

বুধবার ২৬ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর— এসআইআর-এর প্রথম পর্যায়ের শেষ ন’দিনে যাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ হয়, তা নিশ্চিত করতে ১৩ জন নেতাকে বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দিয়েছেন অভিষেক। তাঁরা ওয়ার রুমে ঘুরে ঘুরে বিএলএ-দের সঙ্গে কথা বলে ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা হওয়ার বিষয়টির তত্ত্বাবধান করবেন। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, নথিহীন যাঁদের ফর্ম জমা পড়বে, তাঁদের দ্বিতীয় পর্বে কমিশনের শুনানিতে যেতে হবে। সেই দ্বিতীয় পর্বের ভিত তৈরি করতেই ১০০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধেছেন অভিষেক। কারণ, ফর্ম জমা পড়লে তবেই শুনানিতে ডাক পাবেন সংশ্লিষ্ট ভোটার। ফর্ম জমা না-দিলে সেই সুযোগ থাকবে না। যা তথ্য আছে, তা দিয়েই যাতে ফর্ম জমা হয়, তা-ই নিশ্চিত করতে চাইছেন অভিষেক।

সরকারের প্রস্তুতির মহড়া

প্রথম পর্বের কাজ গুছিয়ে করতে পারলে তবেই দ্বিতীয় পর্বে অগ্রসর হতে পারবে তৃণমূল। সেই পর্বে সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হবে। যে কথা মঙ্গলবার বনগাঁর সভায় বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, যাঁদের নথি থাকবে না, তাঁদের জন্য সরকার ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’-এর ধাঁচে শিবির করে নথি তৈরি করে দেবে। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, যত ফর্ম জমা হবে, তত বেশি করে সরকারের প্রস্তুতি রাখতে হবে। এই পর্বে সেটাও সেরে রাখতে চাইছেন অভিষেক। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘বিজেপি-র ভোটারেরও যদি নথি না থাকে এবং যদি দল এবং আমাদের সরকার মিলে সেটি নথি তৈরি করে দেয় এবং ভোটার তালিকায় সেই ভোটারের নাম ওঠে, তখন ১০ জনের মধ্যে অন্তত দু’জনও ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে মন বদল করবেন। যা গুরুত্বপূর্ণ।’’

সাংগঠনিক নড়াচড়া

১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানোর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে আসলে নিচুতলার সংগঠনে নড়াচড়া আরও বাড়াতে চেয়েছেন অভিষেক। তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার বক্তব্য, ‘‘এসআইআর পর্বে জনসংযোগের কাজে আমরা কয়েক কদম এগিয়েই ছিলাম। অভিষেকের নির্দেশের ফলে তা আরও গতি পাবে।’’ একাধিক নেতার ব্যাখ্যা, অভিষেক যে ভাবে এই ফর্ম জমা করানোর বিষয়টিকে দলীয় পদে থাকার সূচক হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন, তাতে বিএলএ ছাড়া নিচুতলার নেতারাও দুয়ারে দুয়ারে ছুটবেন। শুধু পার্টি অফিসে বসে থেকে গুলতানি করবেন না। এক প্রবীণ মন্ত্রীর কথায়, ‘‘আমাদের ভোট দেবেন না, এমন মানুষও ভোটার তালিকায় নাম রাখার জন্য আমাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এই সময়ে সংগঠন সঠিক ভাবে কাজ করলে আগামী কয়েকটা ভোটের জন্য সেই বিরোধী ভোটারও ‘আমাদের’ হয়ে যাবেন।’’

দলের খাতায় প্রকৃত তথ্য

সোমবারের বৈঠকে অভিষেক উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন এই কারণে যে, বুথস্তরে কাজ হলেও সেই তথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে দলের কাছে সময়মতো আসছে না। ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানোর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে প্রকৃত তথ্য দলের খাতায় থাকা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন অভিষেক। কারণ, দ্বিতীয় পর্বে সেই তথ্যের ভিত্তিতেই কমিশনের বিরুদ্ধে আইনি এবং রাজনৈতিক সংঘাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাইছে তৃণমূল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement