ব্যবস্থা নেওয়ায় বৈষম্য কেন, প্রশ্ন বিচারপতির

বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত যেখানে শেষ করেছিলেন, ঠিক সেখান থেকেই পাড়ুই মামলার শুনানি শুরু করলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ টন্ডন। কেন পাড়ুই-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হল না, তা রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নিজে এসে হাইকোর্টকে জানানো উচিত বলে মঙ্গলবার জানিয়ে দিলেন বিচারপতি টন্ডন। রাজ্য সরকারের কাছে এক দিনের মধ্যে তিনি জানতে চেয়েছেন, এ ব্যাপারে কেন ডিজি-কে তলব করা হবে না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৮
Share:

পাড়ুই-কাণ্ড সরগরম। অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য খোশমেজাজেই। বোলপুর ডাকবাংলো মাঠে মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত যেখানে শেষ করেছিলেন, ঠিক সেখান থেকেই পাড়ুই মামলার শুনানি শুরু করলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ টন্ডন।

Advertisement

কেন পাড়ুই-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হল না, তা রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নিজে এসে হাইকোর্টকে জানানো উচিত বলে মঙ্গলবার জানিয়ে দিলেন বিচারপতি টন্ডন। রাজ্য সরকারের কাছে এক দিনের মধ্যে তিনি জানতে চেয়েছেন, এ ব্যাপারে কেন ডিজি-কে তলব করা হবে না। একই সঙ্গে বিচারপতি জানান, রাজ্য সরকারের জবাব দেখে কাল, বৃহস্পতিবার তিনি ডিজি-র হাজির হওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। পাড়ুই-কাণ্ডে অভিযুক্তদের তালিকায় দু’জন রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে। তাঁরা হলেন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী।

এর আগে পাড়ুই মামলা ছিল বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে। তিনিই পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্তের জন্য ডিজি-র নেতৃত্বে তৈরি করে দিয়েছিলেন বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট। সিটের রিপোর্টে সন্তুষ্ট না হয়ে গত ১০ এপ্রিল ডিজি-কে তাঁর এজলাসে তলব করায় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির এজলাসে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছিল। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশ মঞ্জুর করায় ডিজি-কে আর আদালতে হাজির হতে হয়নি। মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট ঘুরে তাঁর এজলাসে এলেও বিচারপতি দত্ত আর মামলাটি শুনতে চাননি। এর পরেই মামলাটি চলে আসে বিচারপতি টন্ডনের এজলাসে।

Advertisement

বিচারপতি দত্ত এই মামলার শুনানির সময়ে অনুব্রত মণ্ডলকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। ডিজি-কে তাঁর এজলাসে হাজির হতে বলে ১০ এপ্রিল যে লিখিত নির্দেশ বিচারপতি দত্ত দেন, তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘অনুব্রত মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য হওয়ায় সিটের প্রধান ডিজি এবং অন্য অফিসারেরা তাঁকে ছোঁয়ার সাহস করছেন না। অভিযুক্ত সেই রাজনৈতিক নেতা সুযোগটি পুরোপুরি ব্যবহার করছে। তদন্ত সঠিক পথে যে এগোচ্ছে না, এর কারণ সেটাই।’ পরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই অংশটি রায় থেকে বাদ দিয়ে দেন। বিচারপতি টন্ডন সরাসরি অনুব্রতর নাম করেননি। কিন্তু মূল অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতা বলে তিনি যে শাসক দলের ওই দাপুটে নেতাকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তা সরকারপক্ষের কাছেও পরিষ্কার।

এ দিন সকালে পাড়ুই মামলাটি বিচারপতি টন্ডনের এজলাসে শুনানির জন্য ওঠে। ধটনার তদন্ত শেষ জানিয়ে জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বিচারপতি কাছে তদন্ত সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট জমা দেন। বিচারপতি জিপি-র কাছে জানতে চান, ‘রিপোর্টে কী আছে, আপনি পড়েছেন?’ জিপি বলেন, ‘না, মুখবন্ধ খামে ওই রিপোর্ট ছিল। আমি খুলে দেখিনি।’ বিচারপতি টন্ডন বলেন, ‘রিপোর্টটি আপনিই পড়ুন।’

জিপি-র রিপোর্ট পড়া শেষ হলে বিচারপতি টন্ডন জিপি-কে উদ্দেশ করে বলেন, গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজ্য পুলিশের তরফে যে রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই প্রধান অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত পুলিশ। কিন্তু পুলিশ কাউকে ধরেনি। বিচারপতির প্রশ্ন, ‘ওই ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? রিপোর্টে এক মূল অভিযুক্তের প্ররোচনামূলক বক্তৃতার কথা বলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি?’ জিপি-র কাছ থেকে জবাব আসার আগেই বিচারপতির পরের প্রশ্ন, ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কি ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি বা নির্বাচনী আইনে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?’

জিপি নিরুত্তর। বিচারপতি টন্ডন এ বার জানতে চান, ‘অন্য কোনও ক্ষেত্রে এই ধরনের প্ররোচনামূলক ভাষণ দেওয়ায় জন্য পুলিশ কি ব্যবস্থা নিত?’ জিপি জবাব দেননি। বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য করছেন কেন আপনারা?’ এ বার জিপি বলেন, ‘আমি জেনে বলব।’

এর পরেই ফের পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্তের প্রসঙ্গে চলে যান বিচারপতি। জিপি-র কাছে তিনি জানতে চান, ‘রাজ্য পুলিশের যে সিট তৈরি হয়েছে, তার নেতৃত্বে কে রয়েছেন? অভিযুক্তদের কে গ্রেফতার করবে?’ জিপি বলেন, ‘ওই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি।’ বিচারপতির প্রশ্ন, ‘মূল অভিযুক্তদের কেন তাহলে গ্রেফতার করা হচ্ছে না? এর উত্তর তা হলে ডিজি-কে দিতে হবে। আদালতে এসেই ডিজি-র উচিত তা জানানো।’

জিপি বলেন, ‘এর জন্য ডিজি-র আদালতে আসার প্রয়োজন নেই। সিআইডি-র ডিআইজি আদালতে হাজির হতে পারেন।’ জিপি-র এই ব্যাখ্যা বিচারপতি টন্ডনকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিনি জিপি-কে নির্দেশ দেন, ‘রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে কেন আদালতে ডেকে পাঠানো হবে না, তা আপনারা জানান। আমি বৃহস্পতিবারই সেই জবাব পড়ে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাব।’

এ দিন আদালতের মন্তব্যে তাঁরা ফের সাহস পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পাড়ুইয়ের বাঁধনবগ্রামে নিহত সাগরচন্দ্র ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘সিটের তদন্তে আমাদের কোনও আস্থা নেই। তাই আমি কলকাতা হাইকোর্টে গিয়েছিলাম। মূল অভিযুক্তেরা কেউ ধরা পড়েনি। এখনও আমাদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তদের দলবল। অভিযুক্তেরা অস্ত্র নিয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। একমাত্র হাইকোর্টই আমাদের রক্ষা করতে পারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন