ফুটবল মাঠ দাপাচ্ছে রফিয়ারা, দিন বদল চুপিপোতায়

অষ্টম শ্রেণির রফিয়া খাতুন গ্রামের মাঠে দাদা-ভাইদের ফুটবল খেলতে দেখত। তারও খুব ইচ্ছে করত ফুটবল খেলতে। অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বলে শটও মেরেছে। কিন্তু যেখানে রফিয়ার বাড়ি, ধুবুলিয়ার সেই চুপিপোতা গ্রামে মেয়েরা কোনও দিন ফুটবল খেলে না।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

ধুবুলিয়া শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৬:১২
Share:

—নিজস্ব চিত্র।

অষ্টম শ্রেণির রফিয়া খাতুন গ্রামের মাঠে দাদা-ভাইদের ফুটবল খেলতে দেখত। তারও খুব ইচ্ছে করত ফুটবল খেলতে। অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বলে শটও মেরেছে। কিন্তু যেখানে রফিয়ার বাড়ি, ধুবুলিয়ার সেই চুপিপোতা গ্রামে মেয়েরা কোনও দিন ফুটবল খেলে না। একটু বড় হলে ‘পর্দানসীন’ হয়ে যাওয়াই রীতি এখানে।

Advertisement

ছবিটা বদলাতে শুরু করল রফিয়াদের স্কুলের কবাডি টিম ব্লক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর। ‘‘এক দিন মনে হল, ফুটবলটাও খেললে কেমন হয়? কথাটা অন্য মেয়েদের বললাম। সকলেই রাজি। ভয়ে ভয়ে বললাম বাড়িতে। ভাবতে পারিনি, পরিবারের সকলেও এত সহজে রাজি হয়ে যাবে।’’

রফিয়া, বাসন্তী, মাম্পি, অর্পিতা খাতুনরা পায়ে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামতেই চুপিপোতা গ্রামে শুরু হয়ে গিয়েছে একটা অন্য সময়। যেখানে ‘মেয়ে’ বলে আড়ালে থাকার দরকার শেষ হয়ে গিয়েছে। গ্রামের ১০০ শতাংশ বাসিন্দাই মুসলিম। সেখানে মেয়েদের ফুটবল খেলা প্রথমে মানতে পারেননি অনেকেই। বিকেলে একই সঙ্গে মাঠে প্র্যাকটিস করে চুপিপোতা আবাহনী ক্রীড়াচক্র ক্লাবের ফুটবল কোচিং-এর সদস্য নানা বয়সের ছেলেরাও। তা নিয়ে নানা কথা উঠেছিল। কিন্তু বলে শট মারার মতো করেই এ সব কথা উড়িয়ে দিচ্ছে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা।

Advertisement

নবম শ্রেণির ছাত্রী বাসন্তী খাতুনের কথায়, ‘‘কে কী বলল, তা নিয়ে ভাবতে রাজি নই। প্রথম প্রথম যখন স্কুলে কবাডি খেলতাম, তখনও অনেকে অনেক কথা বলেছে। পাইকাতে ব্লক চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছি। এ বার ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জবাব দিয়ে দেব।’’ একই কথা বলছে রফিয়াও। ‘‘গ্রামের বয়স্করা কেউ কেউ একটু অন্যরকম চোখে দেখে। তা দেখুক। আমাদের সাফল্য ওদের দৃষ্টিকে এক দিন ঠিক বদলে দেবে,’’ প্রত্যয় রফিয়ার।

তবে মাঠের লড়াইয়ের থেকে মাঠের বাইরের লড়াইটা যে কম কঠিন ছিল না, তা স্বীকার করছেন ওদের কোচ, নারায়ণচন্দ্র সেনগুপ্ত। আবাহনী ক্লাবের কোচিং করান তিনি, মেয়েদের স্কুলের কবাডির কোচিংও করান। বললেন, ‘‘মেয়েরা যখন এসে ফুটবল খেলার কথা বলল, তখন একটু চমকেই গিয়েছিলাম। ক্লাবে কথা বললাম। ক্লাবকর্তারা উৎসাহই দিলেন।’’

ক্লাবের সম্পাদক আসরফ আলি মল্লিক বলেন, ‘‘পিছনে অনেকে অনেক কথাই বলছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভয়ে সামনে কেউ কিছু বলতে পারছে না।’’ তিনি জানান, আগামী বছর নভেম্বরে মেয়েদের একটি দলও নামানো হবে ক্লাবের টুর্নামেন্টে। ক্লাব থেকে মেয়েদের দেওয়া হয়েছে খেলার পোশাকও।

এখন চুপিপোতার মাঠে ফুটবল পায়ে নিয়মিত খেলছে গ্রামের আট জন কিশোরী। সঙ্গে যোগ দিচ্ছে পাশের তাতলা, ধুবুলিয়া রেলবাজার এলাকার সুমনা, ববিতা, মামনি, নমিতারা। এরা সকলে একই স্কুলের ছাত্রী। কবাডি দিয়ে শুরু করে এখন ফুটবলে। ভোর থাকতে একে একে হাজির হয় শবনম, সানজিনা, মৌসুমি খাতুনরা। চলে শারীরিক অনুশীলন। স্কুল থেকে ফিরে আবার মাঠে। কোচ নারায়ণবাবু গ্রামের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও অনুশীলন করান। টুর্নামেন্টে খেলার স্বপ্ন নিয়ে মেয়েরা বল পায়ে দৌড়য়।

সেই দৌড়ের গতিতে কোথায় মিলিয়ে যায় শতাব্দী-প্রাচীন কুসংস্কার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন