আলিপুর আদালতে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে হাজির করানোর সময় গত শনিবার হট্টগোল করেছিলেন তাঁর অনুগামীরা। বুধবার শিয়ালদহ আদালতে কার্যত একই ঘটনা ঘটালেন হবু ডাক্তারেরা।
এনআরএস হাসপাতালের ছাত্রাবাসে কোরপান শা খুনের ঘটনায় ধৃত ডাক্তারির প্রথম বর্ষের ছাত্র জসিমুদ্দিনের এজলাসের বাইরে এনআরএসের ছাত্ররা এ দিন চিৎকার করে আদালতের কাজে বাধা দেন। শেষ পর্যন্ত ক্ষুব্ধ বিচারক তাঁদের এক জনকে ডেকে কড়া ভর্ৎসনা করার পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
গত ১৬ নভেম্বর সকালে এনআরএসের ছাত্রাবাস থেকে উদ্ধার হয় মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক কোরপান শা-র মৃতদেহ। ওই যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, এই হত্যার ঘটনায় যুক্ত ছাত্রাবাসেরই এক দল ছাত্র। কিন্তু তদন্তের কাজে এনআরএস কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেননি বলে পুলিশের দাবি। ঘটনার প্রায় এক মাস পরে মঙ্গলবার রাতে জসিমুদ্দিন নামে ওই কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জসিমুদ্দিনের বাড়ি মালদহের চাঁচলে। ২০১৩ সালে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মেধা তালিকায় ২৬৭ নম্বরে নাম ছিল তাঁর। এর পরে তিনি ভর্তি হন এনআরএসে। থাকতেন এনআরএস ছাত্রাবাসের চারতলার ৯২ নম্বর ঘরে।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, জসিমুদ্দিনের মোবাইল চুরিকে কেন্দ্র করেই গোলমালের সূত্রপাত এবং তার জেরেই কোরপানকে পেটানো হয়। ওই ছাত্রাবাসের অন্য পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁকে এর আগে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মঙ্গলবার রাতে আরও এক দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এন্টালি থানায় ডেকে পাঠানো হয় জসিমুদ্দিনকে। তদন্তকারীদের দাবি, তাঁর কথায় অসঙ্গতি ধরা পড়াতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
এ দিন বেলা আড়াইটে নাগাদ জসিমুদ্দিনকে হাজির করানো হয় বিচারক অর্পিতা ঘোষের এজলাসে। অভিযুক্তের আইনজীবী পার্থ সাহা জামিনের আবেদন জানিয়ে সওয়াল শুরু করতেই আদালত কক্ষের বাইরে চিৎকার করতে শুরু করেন অভিযুক্তের সহপাঠীরা। তাঁদের দাবি, আদালত কক্ষে তাঁদের ঢুকতে দিতে হবে। এই চেঁচামেচির জেরে কিছু ক্ষণের জন্য পার্থবাবু সওয়াল বন্ধ রাখেন। ক্ষুব্ধ বিচারক পুলিশকে নির্দেশ দেন, সহপাঠীদের এক জনকে এজলাসের ভিতরে আনতে। এক হবু ডাক্তার তখন এজলাসে ঢোকেন। বিচারক তাঁকে বলেন, “আপনারা হবু চিকিৎসক। আপনারা এই ভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেন না। আপনারা যা করছেন, তা আদালত অবমাননার সামিল।” জসিমুদ্দিনের ওই সহপাঠীদের বিরুদ্ধে কোর্টের ইনস্পেক্টরকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেন বিচারক। পরে কোর্ট ইনস্পেক্টর ওই বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেন।
চিৎকার থামলে পার্থবাবু আদালতে জানান, কোরপান খুনে প্রথমে কেউ এফআইআর দায়ের করেনি। ১৬ নভেম্বর সকালে এন্টালি থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর একটি ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে যান এবং কোরপানের দেহ উদ্ধার করেন। ঘটনাস্থল থেকে দশটি বাঁশের টুকরো এবং একটি ব্লেড মিলেছিল। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না, জসিমুদ্দিন ওই খুনে জড়িত।
এর পরে সরকারি আইনজীবী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করে বলেন, কোরপানকে কী ভাবে পেটানো হয়, তা জসিমুদ্দিন স্বচক্ষে দেখেছেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে কোরপানের কোমরের দড়ির দাগের কথা উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, নিহতকে বেঁধে পেটানো হয়েছিল। সরকারি আইনজীবী অভিযুক্তকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে নিয়ে আরও জেরা করার আবেদন জানান। দু’পক্ষের সওয়াল শুনে বিচারক অভিযুক্তকে আগামী ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
পুলিশের দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জসিমুদ্দিন জানিয়েছিলেন, ১৬ নভেম্বর ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি বুঝতে পারেন, ঘরে তাঁর মোবাইল ফোনটি নেই। কিছুক্ষণ পরে তিনি তলার বারান্দায় হট্টগোলের আওয়াজ শোনেন। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন বারান্দার রেলিংয়ে তাঁর মোবাইল ফোনটি রাখা রয়েছে। জসিমুদ্দিনের দাবি, সেখান থেকে মোবাইলটি তুলে নিয়ে তিনি ফের ঘরে ঢোকেন এবং আবার ঘুমিয়ে পড়েন। পুলিশের কাছে এই বয়ান বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। কেন হট্টগোলের কারণ জানতে চাইলেন না, তার সন্তোষজনক জবাব জসিমুদ্দিন দিতে পারেননি। তার জন্যই তাঁকে গ্রেফতার করা হয় বলে তদন্তকারীদের দাবি। পুলিশ সূত্রের খবর, জসিমুদ্দিন নিজে যদি মারধরে জড়িত নাও থেকে থাকেন, তিনিও জানেন কারা জড়িত। সেই নামগুলো তিনি পুলিশের কাছে বলেননি। পুলিশের দাবি, ঘটনার পরে ছাত্রাবাসে কয়েক জনের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে কথা বলেন জসিমুদ্দিন। পুলিশের মতে, মোবাইলের কল ডিটেলস-এর সূত্র ধরেই জানা গিয়েছে, জসিমুদ্দিন-সহ কয়েক জন পুলিশকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, কোরপান খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে কয়েক জন নির্মাণকর্মী, ক্যান্টিন কর্মী-সহ মোট ১৫০ জনের বয়ান নথিভুক্ত হয়েছে। বেশ কয়েক জন বলেছেন, তাঁরা অভিযুক্তদের দেখলে চিনতে পারবেন। ঘটনাস্থলে ১০ জন হবু ডাক্তার হাজির ছিলেন বলে তদন্তে জেনেছে পুলিশ। তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকে এখনও গ্রেফতার কেন করা হয়নি, সেই প্রশ্নও উঠছে।
মূল অপরাধীদের না ধরে শুধু জসিমুদ্দিনকে যে ভাবে ধরা হল, সেটা মেনে নিতে পারছেন না জসিমুদ্দিনের পরিবার ও প্রতিবেশীরা। চাঁচলের প্রত্যন্ত গ্রাম গালিমপুর-কৃষ্ণপুরে জসিমুদ্দিনের বাবা নইমুদ্দিন আহমেদের কাপড়ের দোকান ছিল। ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে সেই দোকানটি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বড় মেয়ে বিএড পড়ছেন। ক’দিন আগেই এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে বই কেনেন জসিমুদ্দিন। বুধবার দিনভর বাবা ফের টাকার জোগাড়ে নেমেছেন। তিনি বলেন, “রাতে কলকাতা রওনা হব। কোথা থেকে কী যে হল বুঝতে পারছি না।” বিস্মিত পড়শিরাও। জসিমুদ্দিনের এক সময়ের শিক্ষক রব্বানি খান বলেন, “আমাদের স্বপ্ন ছিল ও ডাক্তার হয়ে গ্রামে এসে চিকিৎসা করবে। আমাদের একটাই আর্জি, ঘটনার যেন সঠিক তদন্ত হয়।”
একই আর্জি কোরপানের স্ত্রী আরজিনা-রও। বুধবার উলুবেড়িয়ার বাণীতবলায় বাড়িতে বসে তিনি বলেন, “পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছে শুনেছি। এই ঘটনায় আরও অনেকে জড়িত। পুলিশ তাদের কবে গ্রেফতার করবে?”