পানাগড়ে মাটি উৎসবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে গত বুধবার তিনি আক্ষেপ করেছিলেন, “টাকা নেই, সব কেন্দ্র কেটে নিচ্ছে। তাই কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে পারছি না। ডিএ দিতে পারছি না।” আর সে দিন রাতেই দুর্গাপুরের অতিথিশালায় বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলেন, ২০১৫ সালের টেলি সম্মান ধারে ও ভারে আগের রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ! বাংলা টেলি-সিরিয়ালের কলাকুশলীদের মধ্যে এ বার সরকারি সম্মানের প্রাপক কারা হবেন, রাত জেগে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তাঁদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলেন। গত বৃহস্পতিবার সেই তালিকা আসানসোল থেকে নবান্নে পৌঁছয়। ২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার এক অনুষ্ঠানে টেলি-সিরিয়ালের ১০৫ জন শিল্পীর হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, গত তিন বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বহু পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই প্রাপকদের তালিকা এত দীর্ঘ হয়নি। সেই বিচারে টেলি সম্মান ২০১৫ নয়া রেকর্ড গড়তে চলেছে।
দফতর সূত্রের খবর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাত রকমের পুরস্কার চালু করেছেন। বঙ্গবিভূষণ, বঙ্গভূষণ, সঙ্গীত মহাসম্মান, সঙ্গীত সম্মান, মহানায়ক সম্মান, উত্তম সম্মান এবং টেলি সম্মান। গত বছরই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী টেলি-সিরিয়ালের শিল্পীদের সম্মান জানাতে টেলি সম্মান দেন। সে বার ৮৫ জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর তৈরি তালিকা দেখে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অনেকেই বিস্মিত। কারণ, ওই তালিকায় এমন অনেকের নামই রয়েছে, যাঁরা গত বছরও পুরস্কৃত হয়েছেন। ঠিক যেমন, গত তিন বছরে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, রাশিদ খান, পূর্ণদাস বাউল, মাধবী মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেন, দীপক অধিকারী (দেব), শ্রীকান্ত মোহতার মতো কিছু নাম বার বার থেকেছে বিভিন্ন পুরস্কারের তালিকায়।
এই অবস্থায় সরকারি কর্মীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, যে সরকার কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে না পারার জন্য কেন্দ্রকে দায়ী করে, তারা কী করে উৎসব আর পুরস্কার দেওয়ার জন্য এত টাকা খরচ করে। সরকারের সমর্থক কিছু ব্যক্তির নাম সব তালিকাতেই ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের এক কর্তা জানান, এ বার ১০৫ জন প্রাপকের জন্য পুরস্কার-মূল্য ধরা হয়েছে কোটি টাকার উপরে। আর মুখ্যমন্ত্রীর অনুগামী তথা ছায়াসঙ্গী এক চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠানটি আয়োজনের জন্য আরও কোটি খানেক টাকা নেবেন। সব মিলিয়ে কয়েক ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানের জন্য ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে।
তবে মেলা-খেলা-উৎসবের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারের এই খরচ নগণ্য বলেই মনে করছেন সরকারি কর্তাদের একাংশ। নবান্নের এক শীর্ষ আমলার কথায়, “ইমাম-মোয়াজ্জিমদের ভাতা বাবদ ১৮৪ কোটি, চলচ্চিত্র উৎসবে ৩০ কোটি, বেকার ভাতায় ১৮০ কোটি, বিল ভাউচার না দিয়ে আপৎকালীন খরচ বাবদ ২৮১ কোটি, জঙ্গলমহল-সুন্দরবন ফুটবল কাপের জন্য ৩০ কোটি এবং ৬০০০ ক্লাবকে যেখানে ১২০ কোটি টাকা বিলি করা হয়েছে, সেখানে টেলি পুরস্কারের জন্য ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা তো কমই বলতে হবে!”
খরচের থেকেও সরকারি কর্তারা বেশি বিস্মিত পুরস্কার প্রাপকদের নির্বাচন করার পদ্ধতি নিয়ে। কেমন সেই পদ্ধতি?
তথ্য-সংস্কৃতি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি কোনও পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করে প্রাপকদের বাছাই করার কথা। কিন্তু এ বারের তালিকায় থাকা সব নামই যে কমিটির বাছাই করা, এমন কথা হলফ করে বলতে পারছেন না দফতরের কর্তারাই। এক কর্তা জানান, প্রস্তাবিত একটি তালিকা গত বুধবারই দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেই তালিকা দেখে কিছু নাম কেটেছেন, আর বেশ কিছু ঢুকিয়েছেন। ফলে তালিকায় ক’টি নাম কমিটির বাছাই করা, আর কতগুলি মুখ্যমন্ত্রীর, তা নিয়ে তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের কর্তাদের একাংশের মধ্যে সংশয় রয়েছে। এক কর্তা জানান, মুখ্যমন্ত্রী নিজে বাংলা সিরিয়ালের নাড়িনক্ষত্র জানেন। প্রায় সব কলাকুশলীর খবর রাখেন। কোন শিল্পী কখন, কোন সিরিয়ালে কাজ করছেন, কোনটার সম্প্রচার কখন হয় সবই তাঁর নখদর্পণে। সে সব মাথায় রেখে পুরস্কার প্রাপকদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন বিচারকরা। তার পরেও তাঁদের তৈরি তালিকা রাত জেগে কাটাছেঁড়া করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ চূড়ান্ত তালিকা কার্যত মমতারই তৈরি।
সেই তালিকা গত বৃহস্পতিবার আসানসোল থেকে কলকাতায় পৌঁছয়। তার পরে কার্ড ছাপানো থেকে অনুষ্ঠানের অন্য কাজের তোড়জোড় শুরু হয়। এ বার টেলি সম্মানে মোট ২৪টি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হবে। সেরা অভিনেতা, অভিনেত্রী থেকে সেরা কেশবিন্যাস শিল্পীসব স্তরেই পুরস্কার রয়েছে। আর যাঁদের কোনও বিভাগেই ফেলা যায়নি, অথচ মুখ্যমন্ত্রী পুরস্কার দিতে চান, তাঁদের নাম রাখা হয়েছে বিশেষ পুরস্কার প্রাপকের তালিকায়। এ বার এই পুরস্কার পাবেন ২৬ জন। এ ছাড়া মনু মুখোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে-সহ ছ’জনকে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার দেওয়া হতে পারে।
পুরস্কার প্রাপকদের সংখ্যাটা ৮৫ থেকে এ বার এক লাফে ১০৫ হওয়াতেও বিস্মিত অনেকে। কিন্তু টেলিভিশন জগতের একটা অংশের ধারণা, টেলি-সিরিয়ালের কলাকুশলীদের নিজের পাশে রাখতেই এই পদক্ষেপ করেছেন মমতা। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তৃণমূলের নানা অনুষ্ঠান, মিছিল, সমাবেশে টেলিভিশন তারকাদের উপস্থিতি নিয়মিত ভাবে নজরে আসত। কিন্তু গত কয়েক মাসে সেই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পাল্টেছে। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জনা বসু, দেবিকা মুখোপাধ্যায়, দেবরাজ রায়-সহ বেশ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী ইতিমধ্যেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’-এর তালিকায় প্রথমে দেবরাজ রায়ের নাম ছিল। কিন্তু তিনি সম্প্রতি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন বলে সেই তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়েছে। তা ছাড়া, বিজেপির বিভিন্ন মিছিলে নিয়মিত দেখাও যাচ্ছে টেলি দুনিয়ার আরও কিছু মুখ। বিজেপি দাবি করেছে, বিনোদন জগতের তারকাদের আরও বেশি করে তারা তাদের দলে আনতে চায়। এই অবস্থায় আরও বেশি পুরস্কার দিয়ে টেলি দুনিয়ার লোকজনদের মমতা নিজের পাশে রাখতে চাইছেন বলে মনে করছেন অনেকে।
তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের পাশাপাশি টেলি সম্মান অনুষ্ঠানের দায়িত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন রাজ্যের আবাসন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের উপরে। এ ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আর এক প্রযোজকের উপরেও এই অনুষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব রয়েছে। পুরস্কার প্রাপকদের অধিকাংশই আবার ওই প্রযোজনা সংস্থার সিরিয়ালের সঙ্গে যুক্ত। মোটা টাকার বিনিময়ে ওই সংস্থাকেই অনুষ্ঠান আয়োজনের ভার দেওয়া হয়েছে। বার বার ফোন করেও ইদানীং মুখ্যমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী ওই প্রযোজকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। আবাসন মন্ত্রীও থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।