কয়লাখনি বণ্টন নিয়ে মোদী সরকারের নয়া অর্ডিন্যান্সের দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা দেখছে বিভিন্ন মহল। তাঁদের মতে, দেশের ২১৪টি কয়লাখনির নতুন করে নিলামের ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোষাগার যেমন লাভের মুখ দেখবে, তেমনই বিদ্যুৎ, সিমেন্ট ও ইস্পাত সংস্থাগুলিও রেহাই পাবে কয়লা সংকট থেকে। পাশাপাশি, কয়লা উত্তোলন ও বিক্রির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বেসরকারি সংস্থার প্রবেশ ঘটলে কয়লার দাম ও মান নিয়ে শিল্পক্ষেত্রের দীর্ঘদিনের অভিযোগের অবসান ঘটতে পারে বলে অনেকের আশা।
মোদী সরকার আগেই জানিয়েছিল, ২১৪টি খনির মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় খনিগুলি ছাড়া বাকিগুলির নিলাম থেকে সংগৃহীত অর্থ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কোষাগারেই যাবে। এর মধ্যে ৩০টি খনি পশ্চিমবঙ্গে। কাজেই রাজ্যের কোষাগারের বেহাল দশা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার যে আক্ষেপ করেন, নয়া অর্ডিন্যান্স তাতে প্রলেপ দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কত টাকা পেতে পারে রাজ্য? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এ বিষয়ে এখনই স্পষ্ট বলা সম্ভব নয়। কারণ খনি কেনাবেচা হবে নিলামে। তবে কেন্দ্রের একটি কমিটি খনিগুলির ন্যূনতম দর বেঁধে দেবে। তখন হিসেব করে মোটামুটি বলা যেতে পারে, খনি নিলাম থেকে কম করে কত টাকা রাজ্যের কোষাগারে আসছে। বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, উন্নয়নের প্রশ্নে তারা যে রাজনীতি করতে নারাজ, এই অর্ডিন্যান্সই তার প্রমাণ।
এই অর্ডিন্যান্সের জেরেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন রাজ্যের বিদ্যুৎকর্তারা। ২১৪টি খনির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমেরও ৬টি খনি ছিল। নিগমের আশঙ্কা ছিল, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নিলাম বাতিল হয়ে যাওয়ায় ওই খনিগুলি তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখন প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের ফের খনি দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। খনি ফিরে পাবে ডিভিসি এবং ডিপিএল-ও। পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎসচিব গোপালকৃষ্ণ বলেন, “অর্ডিন্যান্স আমি দেখিনি। তবে কেন্দ্র যদি আমাদের খনিগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তা হলে আর জটিলতা থাকবে না। কয়লা নিয়েও রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির কোনও সংকট হবে না।”
বাতিলের তালিকায় সিইএসসি-রও একটি খনি ছিল। তবে তাদের ফের নিলামে অংশগ্রহণ করে ওই খনিটি কিনতে হবে বলেই কয়লা মন্ত্রক সূত্রের খবর। এতে সিইএসসি-র যে বাড়তি খরচ হবে, তা শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের ঘাড়ে গিয়ে চাপতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সিইএসসি-র মতো রাজ্যের অন্যান্য যে বেসরকারি শিল্প সংস্থার হাতে কয়লা খনি রয়েছে, তাদেরও একই ভাবে নিলামে অংশগ্রহণ করতে হবে বলেই কয়লা মন্ত্রকের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সিইএসসি-র প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ ও কয়লামন্ত্রী পীযূষ গয়ালের অবশ্য দাবি, “বিদ্যুতের দাম বাড়বে না। বরং কমতে পারে।” তাঁর যুক্তি, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি সারা বছরই কয়লার অভাবে ধুঁকছে। নতুন করে নিলামের পর খনিগুলি থেকে ফের কয়লা উঠতে শুরু করলে জোগান বাড়বে। আর জোগান বাড়লে দাম কমবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ তৈরির খরচও কমার কথা।”
মন্ত্রক সূত্রেই খবর, কয়লা ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের কথা ভাবতে শুরু করেছে কেন্দ্র। তার মধ্যে সবথেকে বড় পদক্ষেপ হল, বেসরকারি সংস্থাকে কয়লা তোলার অধিকার দেওয়া। বাণিজ্যিক ভাবে তারা কয়লা বিক্রিও যাতে করতে পারবে। এতদিন কোল ইন্ডিয়াই একমাত্র কয়লা তুলে তা বাজারে বিক্রি করতে পারত। মোদী সরকার মনে করছে, বেসরকারি সংস্থাগুলিকে প্রবেশাধিকার দিলে সারা দেশে কয়লার উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ব ভারতের কয়লা প্রধান রাজ্যগুলিতে মাফিয়া-রাজ ও কালোবাজারি কমবে। বেসরকারি সংস্থাগুলির হাত ধরে উৎপাদন বাড়লে বিদেশ থেকে দামি কয়লাও কম আমদানি করতে হবে বলে মন্ত্রক মনে করছে। কারণ এখনই বিদ্যুৎ, সিমেন্ট ও ইস্পাত সংস্থাগুলির চাহিদা মেটাতে বছরে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করতে হয়।
বণিকসভা সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ, ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ। আর এই শিল্পগুলির প্রধান কাঁচামালই হচ্ছে কয়লা। কেন্দ্রের নীতির ফলে এই ধরনের শিল্পে জ্বালানি সমস্যা মিটবে।” ডিভিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং দেশের বিদ্যুৎশিল্পের অন্যতম পরামর্শদাতা রবীন্দ্রনাথ সেন মনে করেন, বেসরকারি সংস্থাগুলি পা রাখলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। সে ক্ষেত্রে কয়লার উৎপাদন যেমন বাড়বে, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, ইস্পাতশিল্প পর্যাপ্ত কয়লাও পাবে।
কোল ইন্ডিয়ার কয়লার দাম ও মান নিয়ে অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিও দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল। তাদের ক্ষোভ ছিল, কোল ইন্ডিয়া চাহিদা মতো কয়লা দিতে পারে না, উল্টে টন-পিছু দামও অনেক বেশি নেয়। তাদের একচেটিয়া বাজারের জন্য দর কষাকষির সুযোগও ছিল না। বিদ্যুৎ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দেশ জুড়ে কয়লার চাহিদা বাড়লেও গত কয়েক বছরে কোল ইন্ডিয়ার উৎপাদন তেমন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। ফলে সমস্যা পড়তে হচ্ছিল বিভিন্ন শিল্প সংস্থাকে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রীর বক্তব্য, “কয়লার অভাবে বিদ্যুতের পাশাপাশি সিমেন্ট ও ইস্পাত কারখানাতেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। সেই কারণেই বেসরকারি সংস্থার কথা ভাবা হচ্ছে।