ব্যবধান মাত্র কয়েক মাসের!
সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের তুমুল বিরোধিতা করে এই সুপ্রিম কোর্টেই গত বছরও সরব হয়েছিল রাজ্যের তৃণমূল সরকার। আজ তারাই শীর্ষ আদালতে আর্জি জানিয়েছে, সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্তে নজরদারি করুক সুপ্রিম কোর্ট!
সারদা-কাণ্ডে মুকুল রায়কে সিবিআই ডেকে পাঠানোর পরেই এই মামলার প্রস্তুতি শুরু হয়। সিবিআই তদন্তে একের পর এক তৃণমূল নেতার জড়িয়ে যাওয়ার মোকাবিলা রাজনৈতিক ভাবে করতে না পেরে আইনি পথ খোঁজা হচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, সিবিআই যে ভাবে দলের একের পর এক শীর্ষনেতাকে গ্রেফতার করছে, তাতে যে কোনও ভাবে বাঁধ দেওয়া। আজ সেই লক্ষ্যেই রাজ্য ও তৃণমূলের তরফে দু’টি পৃথক আবেদন করা হয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যাঁকে ডাকার পরে এই আইনি তৎপরতা শুরু হয়, সেই মুকুল রায় নিজেকে এই মামলায় জড়াননি! রাজ্য সরকারের পাশাপাশি পৃথক ভাবে আবেদন জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র।
সিবিআই তদন্ত চলাকালীন কোনও রাজ্য সরকার সেই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করছে এবং আদালতের নজরদারি চাইছে, এমন ঘটনা প্রায় নজিরবিহীন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে হওয়া সিবিআই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টেরই দ্বারস্থ হওয়ার নজিরও নেই।
কোন যুক্তিতে রাজ্য এমন নজরদারি চাইছে? রাজ্য সরকার ও তৃণমূল, দাবি এক হলেও দুই আবেদনের যুক্তি আলাদা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন সিবিআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। আজ সেই অভিযোগ তুলেই আদালতে আবেদন করেছেন মহুয়া মৈত্র। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার এবং অমিত শাহ, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ও রাহুল সিংহ এই তিন বিজেপি নেতার কথায় কাজ করছে সিবিআই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এই মামলায় নিজেদের জড়িয়ে তৃণমূল কি কার্যত মেনে নিচ্ছে যে, দল সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত? কারণ মহুয়া তাঁর আবেদনে যুক্তি দেখিয়েছেন, সিবিআই তদন্তে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সেই জন্যই তিনি দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই মামলায় শরিক হতে চাইছেন। আদালতে মহুয়া জানিয়েছেন, শীর্ষ নেতাদের জেলে ভরে তৃণমূলকে নেতৃত্বহীন করার চেষ্টা হচ্ছে। দল তথা রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানো হচ্ছে। কলকাতা-সহ ৯১টি পুরসভায় আসন্ন ভোটের দিকে লক্ষ্য রেখেই এই চক্রান্ত চলছে।
রাজ্যের আবেদনে কেন্দ্র বা বিজেপি নেতাদের নাম করে অভিযোগ তোলা হয়নি। তবে সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রাজ্যের বক্তব্য, সিবিআই-প্রধানকেই টু-জি তদন্ত থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির কিনারা যে সিবিআই এখনও করতে পারেনি, তা-ও উল্লেখ করেছে তারা। রাজ্যের বক্তব্য, সিবিআই সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি ও কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে উন্নয়নের কাজে বাধা পড়ছে। এই কারণে সংবাদমাধ্যমকে সিবিআই সূত্রে পাওয়া খবর প্রকাশ থেকে নিরস্ত করার আবেদন জানিয়েছে রাজ্য। যা দেখে বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্য সরকার কার্যত সংবাদপত্রের বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে।
রাজ্যের লিখিত আবেদনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ না করলেও রাজ্য সরকারের আইনজীবী তথা কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল কিন্তু তৃণমূলের অভিযোগকে হাতিয়ার করেই সওয়াল করেছেন। আজ সকাল সাড়ে দশটায় বিচারপতি টি এস ঠাকুরের বেঞ্চে সিব্বল রাজ্য সরকারের তরফে আবেদন জানিয়ে অবিলম্বে শুনানির আর্জি জানান। গত মে মাসে বিচারপতি ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চই সারদায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। বিচারপতি ঠাকুর এ দিন সিব্বলের কাছে জানতে চান, এত তাড়া কীসের? কেন অবিলম্বে এই মামলা শুনতে হবে? সিব্বলের জবাব, “সিবিআইয়ের তরফে তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আগেই অন্য দলগুলির কাছে তথ্য চলে যাচ্ছে। অভিযুক্তকে ডাকার আগেই অন্যরা জেনে যাচ্ছেন, কাকে ডাকা হবে।” বিচারপতি জানান, তাঁর এবং বিচারপতি নাগাপ্পনের বেঞ্চ যে হেতু সারদায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল, তাই ওই বেঞ্চই ফের এই মামলাটি শুনতে পারে। বৃহস্পতিবার ওই বেঞ্চ বসলে মামলাটি শোনা হবে।
বৃহস্পতিবার রাজ্যের বিরুদ্ধেও একগুচ্ছ অভিযোগ উঠতে চলেছে। সিবিআই তদন্তে তৃণমূল নেতাদের নাম জড়ানোর পরেই রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ ও বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী কলকাতায় সিবিআই দফতরের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। মদন মিত্রের গ্রেফতারের পর রাস্তায় নামেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ও রাজ্যের দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। ওই দু’টি মামলার আইনজীবী শুভাশিস ভৌমিক বলেন, “আগামী কাল আমরাও আদালতে আবেদন জানাব, বৃহস্পতিবার রাজ্যের পাশাপাশি যেন আমাদের বক্তব্যও শোনা হয়।” মহুয়া মৈত্র যে আবেদন জানিয়েছেন, তার আইনজীবী প্রাক্তন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বিবেক টাঙ্খা। সিব্বলের মতো বিবেকও কংগ্রেস নেতা। তিনি মধ্যপ্রদেশ থেকে কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভায় ভোটে লড়েছিলেন।
এর আগে সারদায় সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করে কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে আইনি লড়াই চালিয়েছিল রাজ্য। স্বাভাবিক ভাবেই এ বারেও প্রশ্নের মুখে তারা। রাজ্যের যুক্তি, সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে কাজ করছে না। ফলে সারদা কেলেঙ্কারির অভিযুক্তদেরই সুবিধা হচ্ছে। কী ভাবে? রাজ্যের বক্তব্য, সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার আগে ‘সিট’ সারদার তদন্ত করছিল। আটটি মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল। ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার একটি মামলায় সুদীপ্ত সেন দোষী সাব্যস্ত হন। তিন বছর কারাদণ্ডও হয়। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সিবিআই এই সব মামলার দায়িত্ব নেয়নি। সেগুলির শুনানি বন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে সুদীপ্ত সেন-কুণাল ঘোষের মতো মূল অভিযুক্তরা একাধিক মামলায় জামিন পেয়ে গিয়েছেন।
রাজ্যের আরও যুক্তি, সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে সারদা ও অন্য বেআইনি লগ্নিসংস্থার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগের তদন্ত করতে বলেছিল। কিন্তু তারা তা করছে না। রাজ্যের আবেদন, অবিলম্বে সমস্ত মামলার তদন্তভার হাতে নেওয়ার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দিক আদালত। সেবি, কোম্পানি নিবন্ধক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি প্রয়োজন বলে রাজ্যের যুক্তি।
মহুয়া মৈত্রর আবেদনে বলা হয়েছে, সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মতো বিজেপি নেতারা যেমন ভবিষ্যৎবাণী করছেন, সিবিআইয়ের তদন্তে তেমনটাই ঘটছে। তিনি কলকাতায় অমিত শাহর জনসভায় মদন মিত্র, মুকুল রায়, মমতার নাম করেছিলেন। মুকুলের হাতে সিবিআইয়ের সমন পৌঁছনোর আগেই তিনি তা জেনে যান। সিদ্ধার্থনাথের জবাব, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই কুণাল, মদন, মুকুল ও নিজের নাম করে আগাম ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। ভাইপো অভিষেকের নামও বলে রেখেছেন।” মহুয়ার অভিযোগ, নবান্নে খবর পৌঁছনোর আগেই তৃণমূলের কোন নেতা-মন্ত্রীকে সিবিআই গ্রেফতার করবে, তা বিজেপি নেতারা জেনে যাচ্ছেন। যা থেকে স্পষ্ট, বিজেপির নির্দেশেই কাজ করছে সিবিআই। সিবিআই কাকে জেরা করবে, কাকে গ্রেফতার করবে, সে খবর আগাম পাচ্ছে সংবাদমাধ্যমও।