সুনীল উপাধ্যায়
কলকাতা জাদুঘরের মুখ্য সংরক্ষণ আধিকারিক সুনীল উপাধ্যায়ের অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত করবেন দময়ন্তী সেন। আজ সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশ দিয়েছে। দময়ন্তী এখন সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি ও ডিআইজি পদে রয়েছেন।
কলকাতা জাদুঘরের দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী নিয়ে বেআইনি কাজকারবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেই কি সরে যেতে হল জাদুঘরের মুখ্য সংরক্ষণ আধিকারিক সুনীল উপাধ্যায়কে? মূলত এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজারই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দময়ন্তী সেনকে। সুপ্রিম কোর্টের মতে, কলকাতা পুলিশ এখনও পর্যন্ত সুনীলের অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তে যথেষ্ট তৎপরতা দেখায়নি। কলকাতা জাদুঘর থেকে দুষ্প্রাপ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী কী ভাবে বিদেশের নিলাম ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে শীর্ষ আদালত। সংস্কৃতি মন্ত্রককে চার সপ্তাহের মধ্যে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে।
গত ৩ জুলাই কলকাতার চারু মার্কেট থানা এলাকায় নিজের বাসভবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যান সুনীল উপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অফিসার কলকাতা জাদুঘরের মুখ্য সংরক্ষণ আধিকারিক হিসেবে দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। এক মাস পরেও সুনীলবাবুর খোঁজ না মেলায় তাঁর আত্মীয়রা সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়ে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়েছিল, কলকাতা জাদুঘরে দুষ্প্রাপ্য শিল্প ও প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সংক্রান্ত বেনিয়ম নিয়ে মুখ খুলেছিলেন সুনীলবাবু। তাঁর রহস্যজনক অন্তর্ধানের পিছনে সেটাই কারণ কি না, সেই প্রশ্নও তোলা হয়।
আবেদনকারীর আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে কলকাতা জাদুঘরের বেনিয়ম নিয়ে সিএজি-র রিপোর্ট পেশ করে জানান, সুনীলবাবু যে অভিযোগ তুলেছিলেন, সিএজি-র রিপোর্টেও সেই একই কথা বলা হয়েছে। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে চেলামেশ্বর এবং বিচারপতি এস এ বোড়দে-ও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বেঞ্চের মত ছিল, কলকাতা পুলিশই তদন্ত করুক। কিন্তু এক জন আইজি স্তরের আইপিএস অফিসারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে মামলাকারীদেরই নাম প্রস্তাব করতে বলেছিলেন বিচারপতিরা। সেই প্রস্তাব অনুযায়ীই আজ দময়ন্তী সেনকে তদন্ত ভার দেওয়া হয়েছে।
৩৪ বছর বয়সি সুনীলবাবুর অন্তর্ধান ঘিরে প্রথম থেকেই রহস্য তৈরি হয়েছে। ৩ জুলাই তিনি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সময় নিজের মোবাইল ফোনটি বাড়িতেই রেখে গিয়েছিলেন। পর দিনই পুলিশকে তাঁর অন্তর্ধানের বিষয়ে পুলিশকে জানানো হয়। কলকাতা পুলিশ এফআইআর নিতে চায়নি। ঘটনার ১৫ দিন পরে সুনীলবাবুর ভাইয়ের লিখিত অনুরোধে পুলিশ এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু এক মাস পরেও সুনীলবাবুর কোনও খোঁজ না মেলায় তাঁর আত্মীয়রা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সুনীলবাবু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। তাঁর সতীর্থদের সাহায্যেই সুনীলবাবুর আত্মীয় কৃষ্ণমোহন উপাধ্যায় গত অগস্ট মাসে শীর্ষ আদালতে মামলা করেন।
সুপ্রিম কোর্ট প্রথমে প্রশ্ন তুলেছিল, আবেদনকারীরা কেন কলকাতা হাইকোর্টে যাচ্ছেন না? আবেদনকারীরা জানান, সুনীল জাদুঘরে অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খোলার পরেই নিখোঁজ হয়ে যান। এই ঘটনায় দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর চোরা কারবারিদের হাত থাকতে পারে। এ জন্য এমন পেশাদার তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন যারা প্রত্নতাত্ত্বিক ও শিল্প সামগ্রীর চোরাকারবারিদের মোকাবিলা করতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপর যে তাঁদের আস্থা নেই, তা-ও জানিয়েছিলেন তাঁরা। সুনীলবাবুর আত্মীয়রা জানান, কলকাতা পুলিশ কোনও কূলকিনারা করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে রাজ্য সরকারেরও বক্তব্য জানতে চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়, সুনীলবাবুর অন্তর্ধানের পিছনে অন্য কোনও রহস্য নেই। চাকরিতে পদোন্নতি না পেয়ে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। কিন্তু বিচারপতিরা রায় দেন, সত্যি-মিথ্যা যাচাই করার জন্য আরও তথ্য প্রয়োজন। এর পরেই আবেদনকারীরা সুপ্রিম কোর্টে কলকাতা জাদুঘর নিয়ে সিএজি-র রিপোর্ট পেশ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে সিএজি রিপোর্ট দিয়েছিল, কলকাতা জাদুঘরে দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। কোন পথে এই সব দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী সোদবি’জ, ক্রিস্টি’জ-এর মতো আন্তর্জাতিক নিলাম ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে সিএজি। রিপোর্টে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, কলকাতা জাদুঘর থেকে আসল সামগ্রী পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। তার বদলে নকল সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হচ্ছে।
গত ৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এ বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিচারপতি চেলামেশ্বরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ মন্তব্য করে, “আমাদের দেশের মূল্যবান সামগ্রী লন্ডনে বা অন্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছে। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন। কেন্দ্রীয় সরকারেরও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। জাদুঘরের বিষয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তা যথেষ্ট গুরুতর।” আজ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে রাজ্য সরকারের আইনজীবী অনীপ সাচতে জানান, রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ১৩ নভেম্বর সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।