খাগড়াগড়-কাণ্ডের পরে রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং জেহাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে তৃণমূলের যোগসাজশ নিয়ে আসরে নেমেছে বিজেপি। ওই ঘটনার পরে অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়েও নতুন করে সরব হয়েছে তারা। চাপে পড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে দায় চাপাতে ব্যস্ত। তাঁর বক্তব্য, সীমান্ত পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব তো কেন্দ্রের! এই চাপানউতোরের মধ্যেই এ বার রাজ্য পুলিশ এবং বিএসএফের দুই শীর্ষ কর্তাকে মুখোমুখি বসিয়ে আলোচনায় সচেষ্ট হল কেন্দ্র।
আলোচনার টেবিলে রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর যুক্তি-পাল্টা যুক্তি শুনতে তৎপর হয়েছেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহই। আসন্ন সপ্তাহান্তেই গুয়াহাটিতে ডিজি সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন রাজনাথ। সাম্প্রতিক কালের মধ্যে এই প্রথম দিল্লির বাইরে ডিজি-দের ওই বাৎসরিক বৈঠক হতে চলেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাই ওই সম্মেলনের মুখ্য আলোচ্য। কিন্তু সেই অবসরকেই রাজনাথ ব্যবহার করতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য। গুয়াহাটিতে নৈশভোজের আসরে তাঁর দু’পাশের আসনে বিএসএফের ডিজি দেবেন্দ্র কুমার পাঠক এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে বসিয়ে দু’তরফের বক্তব্যই শুনতে চাইছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আপাতদৃষ্টিতে এই উদ্যোগ প্রশাসনিক হলেও এর তাৎপর্য অবশ্যই রাজনৈতিক। আগামী রবিবারই কলকাতায় সভা করতে আসছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ সমস্যা এবং রাজ্য প্রশাসনের শিথিলতায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়া নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সরব হওয়ার কথা তাঁর। অমিতের পাল্টা সভা করে পরের দিনই তৃণমূল আবার অবধারিত ভাবে পাল্টা বলবে, কেন্দ্র তার দায়িত্ব পালন না-করে শুধু রাজ্যকে দোষারোপ করছে। রাজনৈতিক ভাবে মমতার এই হাতিয়ার যাতে বিশেষ কার্যকর না হয়, তার জন্যই এ বার উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এবং উদ্যোগী হওয়ার আগে নেপথ্যে দু’টি কাজ সেরে নিয়েছেন রাজনাথ তথা তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দিয়ে এ রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতির সরেজমিন সমীক্ষা করে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশিই দিল্লিতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কাছ থেকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং তাকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন রাজনাথ ও তাঁর প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজিজু। তার পরেই দুই ডিজি-কে এক টেবিলে বসানোর উদ্যোগ। সম্ভব হলে জানুয়ারিতে এ রাজ্যে আসতেও পারেন রাজনাথ।
কেন্দ্রীয় সরকারের এক আধিকারিকের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সমস্যা সতিই উদ্বেগজনক। সীমান্ত পেরিয়ে অবাধ চোরাচালান এবং আরও কিছু ঘটনা পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে তুলছে। এ সবের সঙ্গে আবার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কও জড়িত। তাই এই নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের চাপানউতোর অভিপ্রেত নয়। কার কোথায় সমস্যা হচ্ছে, শুক্র ও শনিবার গুয়াহাটিতে ডিজি সম্মেলনের অবসরে সেটাই বোঝার চেষ্টা হবে।” বিএসএফ কেন অনুপ্রবেশ আটকাতে পারছে না, তা নিয়ে এখন নিয়মিতই সরব মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু ঘটনার স্পর্শকাতরতা বুঝেই এই বিতর্কে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ বিএসএফের ডিজি পাঠক। দিল্লিতে বুধবারই বিএসএফের একটি অনুষ্ঠানে এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, খাগড়াগড়ের ঘটনায় এনআইএ তদন্ত চলাকালীন এ ব্যাপারে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে বিএসএফ সূত্রে বলা হচ্ছে, “সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব যৌথ ভাবেই পালন করে রাজ্য ও কেন্দ্রের নানা সংস্থা। সেখানে এমন কোনও মন্তব্য অভিপ্রেত নয়, যা বাহিনীর মনোবল নষ্ট করে।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে দেওয়া কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্টে বিশদে উল্লেখ করা হয়েছে এ রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু এবং মাদক-সহ অন্যান্য পাচারের কাহিনি। উত্তর ২৪ পরগনার ঘোজাডাঙা, হাকিমপুর, স্বরূপনগরের মতো সীমান্তের কথা বলে জানানো হয়েছে, কী ভাবে হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ থেকে গরু এনে এ রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে বিপুল দামে হাত বদল করে দেওয়া হচ্ছে ও’পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গরু পিছু সীমান্ত পার করার খরচ পড়ছে প্রায় চার হাজার টাকা। বিএসএফের একাংশও যে পাচার চক্রের সঙ্গে সামিল, তা-ও অবশ্য রয়েছে রিপোর্টে। সীমান্তে টানা বেড়া না থাকা (রিপোর্টের ভাষায় ‘ইন্টারমিটেন্ট ফেন্সিং’) যে এই সব কাজকর্মের সুবিধা করে দিচ্ছে, এই জানা তথ্যও ফের ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ঘটনা হল, গরু পাচার আটকানোর জন্য রাজনৈতিক ভাবেই বাংলায় এখন আসরে নেমেছে বিজেপি। কলকাতা বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় সম্প্রতি গরুর লরি আটকে অবরোধ করে তারা এক দিন চাঞ্চল্যও তৈরি করেছিল। গরু পাচার চক্র এখন যে হেতু তৃণমূলের আয়ের বড় উৎস, তাই সেখানে আঘাত হানাও বিজেপির লক্ষ্য। আর কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে, প্রশাসনিক ভাবেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের দিকে ওঠা অভিযোগ ভোঁতা করে দিতে।
রাজ্যের এক মন্ত্রীর বক্তব্য, “অনুপ্রবেশ বা পাচার, কোনওটাই তো তৃণমূল আমলে শুরু হয়নি! বহু যুগ ধরে চলে আসছে। অহেতুক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা না করে কেন্দ্র যদি সমস্যা সমাধানে সত্যিই উদ্যোগী হয়, ভাল কথা!” বিজেপি নেতারা অবশ্য বলছেন, সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হলে তার কৃতিত্ব কেন্দ্রেরই হবে। এবং তার ‘সুফলে’র ভাগ তাঁরাও পাবেন!